ম্যাচটা দুলছিল পেন্ডুলামের মত একবার বাংলাদেশের দিকে, আরেকবার ভারতের দিকে। অ্যাডিলেড ওভালে বৃষ্টি আসার আগ পর্যন্ত তো বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনাই ছিল শতভাগ; কিন্তু বৃষ্টি এসে সব গুলিয়ে দিলো। ডাকওয়ার্থ অ্যান্ড লুইস সাহেবের বৃষ্টি আইনে যখন বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ালো ১৬ ওভারে ১৫১, তখনও সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু বৃষ্টির পর বাংলাদেশ দলের এলোমেলো ব্যাটিং সেই সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দিলো। জয়ের দারুণ সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা ম্যাচটির পরিণতি হলো রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তি এবং বাংলাদেশের ৫ রানে হার (ডিএল মেথডে)। শুরুতেই নাজমুল হোসেন শান্তর অমার্জনীয় ভুল সেই সম্ভাবনাকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে আসে। দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে লিটনকে রানআউট করালেন তিনি। নিজেও তেড়েফুঁড়ে খেলতে গিয়ে হলেন আউট।
লিটন টি-টোয়েন্টি উপযোগি মারমুখি ব্যাটিংয়ের যে পথ দেখিয়ে গেলেন, সেটাকে অনুসরণ করতে পারেনি কেউই। সাকিব, আফিফরা মনে করেছিলেন, আকাশে বল তুলে দিলেই সম্ভবত ছক্কা হয়ে যাবে। কিন্তু ৩০ গজের বৃত্তও পার হলো না তাদের শট। তালুবন্দী হয়ে ধরতে হলো সাজঘরের রাস্তা।
শেষ মুহূর্তে শেষ সলতেটা জ্বালিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন নুরুল হাসান সোহান। কিন্তু ভারতীয়দের হিসেবি বোলিং তার সেই চেষ্টাকে সফল হতে দিলো না। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ২০ রান। এক ছক্কা এবং এক বাউন্ডারিসহ সোহান নিতে পারলেন ১৪ রান। যার ফলে বাংলাদেশ হেরে গেলো মাত্র ৫ রানের ব্যবধানে। আফসোস থেকে গেলো আর ১টি কিংবা ২টি বলের। এ সুযোগটা পেলে হয়তো বাংলাদেশ জিতেও যেতে পারতো।
ঠিক ২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালুরুর সেই ম্যাচটির মত নয় হয়তো। তবে প্রায় একই রকম। শেষ মুহূর্তে এসে আবারও হারতে হলো বাংলাদেশকে। ব্যাঙ্গালুরুতে শেষ ওভারে মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকদের ভুলে মাত্র ১ রানে জয় পেয়েছিলো ভারত। তারও এক বছর আগে, ২০১৫ সালে এই অ্যাডিলেড ওভালেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ।
এবার সেই অ্যাডিলেড ওভালে ইতিহাস রচনার দ্বারপ্রান্তে এসে আবারও হারতে হলো টাইগারদের। একেবারে নিশ্চিত জয়ের ম্যাচটিকেও পরাজয়ে রূপান্তরিত করে দিলো টাইগার ব্যাটাররা। অথচ, দেখুন! বৃষ্টির আগে এবং বৃষ্টির পর বাংলাদেশের খেলায় কতটা আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যেখানে বিনা উইকেটে ছিল ৬৬ রান, সেখানে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ব্যাটিং করতে না পারায় পরাজয়ই বরণ করতে হলো।
এই পরাজয়ের পর নিশ্চিত- অনেকগুলো যদি, কিন্তু’র আফসোস যোগ হবে। নিশ্চিত বলা হবে, নাজমুল হোসেন শান্ত যদি এতগুলো বল নষ্ট না করতেন! লিটনের মত না হোক অন্তত সিঙ্গেলসের ওপর থাকলেও ২৫ বলে তার রান হতো কম করে ৩৫। কিন্তু তিনি করলেন ২১ রান। আবার যদি, তিনি ওই দ্বিতীয় রানটি নিতে গিয়ে লিটনকে রানআউট না করতেন! তাহলে তো ভিন্ন হতে পারতো ম্যাচের চিত্র!
আবার লিটনের মত না হোক, সাকিব-আফিফরা যদি তার অর্ধেকও খেলতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশের জয়ই নিশ্চিত ছিল। অথচ, পরিকল্পনামত খেলতে না পেরে আকাশে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরলেন তারা।
অন্যদিকে, ইয়াসির আলী রাব্বিকে যে কেন শুধু শুধু একাদশে নেয়া হয়, সেটাই বুঝে আসে না বাংলাদেশের সমর্থকদের। একটি ম্যাচেও ভালো খেলা দেখাতে পারেননি। অথচ, জেনুইন ব্যাটার হিসেবে জায়গা পান একাদশে। মাঠে নামেন যেন শেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু শেখা তার আর শেষ হয় না। আজও ৩ বলে ১ রান করে বিদায় নেন তিনি।
ভারতের করা ১৮৪ রানের জবাব দিতে নেমে লিটন দাস যে ঝড়ো সূচনা করেছিলেন, তাতে পিলে চমকে গেছে ভারতেরই। পরাজয়ের শঙ্কা পেয়ে বসে তাদের। বৃষ্টির সময় তো ১৭ রানে পিছিয়ে ছিলো তারা। ৭ ওভারে এ সময় বাংলাদেশের রান ছিল ৬৬। লিটনের রান ছিল ২৬ বলে ৫৯, আর শান্তর রান ছিল ১৬ বলে কেবল ৭। কিন্তু বৃষ্টির পর চিত্রটা পুরোপুরি উল্টে যায়।
ডিএল মেথডে পরিবর্তিত লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৬ ওভারে ১৫১। ৭ ওভারে ৬৬ রান তুলে ফেলার পর পরের ৯ ওভার তথা ৫৪ বলে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৮৫ রানের। এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভার, তথা ম্যাচের ৮ম ওভারেই দুর্ভাগ্যজনক রানআউট হয়ে যান লিটন দাস।
২৬ বলে ৫৯ রান নিয়ে বৃষ্টির পর খেলতে নামেন লিটন। ৮ম ওভারের প্রথম বলে অশ্বিনের কাছ থেকে ১ রান নেন তিনি। দ্বিতীয় বলে নাজমুল হোসেন শান্ত দ্বিতীয় রান নিতে গিয়েই বিপদে ফেলে দেন লিটনকে। তবে দুর্ভাগ্য লিটনের, লোকেশ রাহুলের সরাসরি থ্রো গিয়ে আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। ৬০ রানে রানআউট হয়ে গেলেন লিটন।
লিটনকে রানআউট করার পর শান্ত নিজে থেকে যেন মনে হচ্ছিল ম্যাচের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একটি বাউন্ডারি এবং একটি ওভার বাউন্ডারিই তার প্রমাণ। কিন্তু ভারতীয়দের হিসেবি বোলিংয়ের মুখে তার এই দায়িত্ব নেয়াটা বেশিক্ষণ টিকলো না। মোহাম্মদ শামির বলে সুর্যকুমার যাদবের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান তিনি। আউট হওয়ার আগে ২৫ বলে করেন ২১ রান।
আফিফ হোসেন ধ্রুব এবং সাকিব আল হাসানও প্রয়োজনে মারকুটে ব্যাটার হয়ে উঠতে পারেন; কিন্তু আজ সেটা পারলেন না। ৫ বল খেলে ৩ রান করে রান তোলার তাড়ায় ক্যাচই তুলে দেন আফিফ। ওনেক ওপরে উঠে যায় বল। সুর্যকুমার যাদব বলটি তালুবন্দী করে নেন। আর্শদ্বিপ সিংয়ের বলেই ফিরে যান সাকিব আল হাসান। আফিফের মতই ক্যাচ তুলে দেন আকাশে। সেটি তালুবন্দী করেন পরিবর্তিত ফিল্ডার দিপক হুদা।
হার্দিক পান্ডিয়ার বলে ১ রান করে ক্যাচ তুলে দেন ইয়াসির আলি রাব্বি। সেই ক্যাচ ধরেন আর্শদ্বিপ সিং। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত মাঠে নেমে একটি ছক্কা হাঁকিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করলেন। পান্ডিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত বলে বোল্ড হয়ে গেলেন তিনি। নুরুল হাসান সোহান ১৪ বলে ২৫ রান করে চেষ্টা করেন জয়ের। সঙ্গে তাসকিনের ৭ বলে ১২ রানের চেষ্টাও ছিল; কিন্তু ৬ উইকেটে ১৪৫ রানে থেমে যায় বাংলাদেশ এবং হেরে যায় ৫ রানে।
এর আগে টস জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। তাসকিন আহমেদের আগুনে বোলিংয়ে ম্যাচটা শুরুও হয়। কিন্তু শরিফুল ইসলাম আর হাসান মাহমুদের বাজে বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেট হারিয়ে ১৮৪ রান সংগ্রহ করে ভারত। ৪৪ বলে ৬৪ রান করেন বিরাট কোহলি। ৩২ বলে ৫০ রান করেন লোকেশ রাহুল। ১৬ বলে ৩০ রান করেন সুর্যকুমার যাদব। ৬ বলে ১৩ রানে অপরাজিত থাকেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন।
তাসকিন ৪ ওভারে দেন মাত্র ১৫ রান। একটি উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু হাসান মাহমুদ ক্যাচ ড্রপ করায় সেটা আর হয়নি। শরিফুল ৪ ওভারে ৫৭ রান দেন। হাসান মাহমুদ দিয়েছেন ৪৭ রান। তবে তিনি ৩ উইকেট নেন। সাকিব ৩৩ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট।