দেশে ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে শরতের শেষ সময়েও ডেঙ্গি সংক্রমণ বাড়ছে। ভাইরাসটির রেকর্ড ভাঙার দৌড়ে প্রতিদিনই নতুন রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে আলাদা ওয়ার্ড তৈরি করেও চাপ সামলানো যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, এবার আক্রান্তদের অবস্থা দ্রুতই খারাপ হচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদদের দাবি মশা দমনে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। মশার হটস্পট ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে না। লার্ভা নিধনে নামকাওয়াস্ত সার্ভিলেন্স এবং প্রচার চালিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি করপোরেশন। বাস্তবে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ দেশবাসী।
এদিকে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে ৬৪২৫ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গিতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গিজ্বর নিয়ে ৬৪৭ জন হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু হয়েছে একজনের। বর্তমানে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪৮১ জনে। সবমিলিয়ে এ বছরে ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগী সংখ্যা ২২ হাজার ৫১৭ । এর মধ্যে রাজধানীতেই ১৬ হাজার ৭৬২ জন ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭৫ জন মারা যায় বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিশ্চিত করেছে।
মাসভিত্তিক রোগী ভর্তি বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মেতে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ জন, আগস্টে ৩ হাজার ৫২১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গি রোগী ভর্তি হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে। ওই মাসে ৯ হাজার ৯১১ জন ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ৩৩০ জন ডেঙ্গিজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গিতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দেশে এ পর্যন্ত এটাই এক বছরে সর্বোচ্চ ভর্তি রোগী। সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয় ২৬ জনের। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গির সংক্রমণ তেমন দেখা না গেলেও ২০২১ সালে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জন মারা যান। এবার পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে ডেঙ্গি রোগী ৩০ থেকে ৪০ হাজার পেরিয়ে যেতে পারে।
সরেজমিন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ঘুরে ডেঙ্গি রোগীর ভিড় দেখা যায়। চিকিৎসকরা যুগান্তরকে জানান, ডেঙ্গিজ্বর নিয়ে জানুয়ারিতে দুজন ভর্তি হলেও অক্টোবরের প্রথম বারো দিনে ১১৯ শিশু ডেঙ্গি নিয়ে ভর্তি হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল, মুগদা জেনারেলসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে রোগীরা শয্যা সংকটে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দেশে প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিবছর ডেঙ্গি রোগ বাড়ে-কমে। এখানে সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকাণ্ডের প্রভাবই পড়ে না। এবার পরিস্থিতি ছড়ানোর জন্য বেশি সহায়ক ছিল বৃষ্টিপাত। চলতি বছরের প্রথমদিকে বৃষ্টি ছিল, মাঝে কমে গেলেও শেষদিকে বাড়ছে। যা ডেঙ্গি মশা বংশবিস্তারে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে। উচ্চ তাপমাত্রাতেও মশা বেশি কামড় দেয়। এসব কারণে গত কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গি রোগী বাড়ছে।
তিনি বলেন, সাধারণত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ডেঙ্গি কমে আসে। কিন্তু এবার পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে অক্টোবরের শেষের দিকে চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে। যা উদ্বেগজনক দিকে যাচ্ছে। আগে ঢাকায় বেশি আক্রান্ত হয়ে অন্যান্য জায়গায় ছড়াত। যা নিয়ন্ত্রণ রাখা যেত। এবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। যতটুকু জানা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গি রোগীদের রেকর্ড রাখা হচ্ছে না। উপকূলীয় অঞ্চলেও রোগী বাড়ছে। এতে বাংলাদেশ ডেঙ্গির হাইপার এন্ডেমিক (প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে উচ্চমাত্রার দিকে যাওয়া) পরিস্থিতি চলে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, মশা পরিস্থিতি দেখতে প্রতিবছর প্রি মনসুন, পোস্ট মনসুন ও মনসুন সার্ভিলেন্স করা হচ্ছে। যেটি কাজে লাগছে না। স্ট্যান্ড প্রসিডিউর হলো ইয়ার রাউন্ড সার্ভিলেন্স অর্থাৎ বছরব্যাপী এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড করতে হবে। মশা ধরে দেখতে হয় সেটি ভাইরাসবাহী কিনা, হলে কোন সেরোটাইপ। বছরের প্রথমদিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল শহরের যেসব স্থানে জ্বরের রোগী পাওয়া যাবে, তারা ডেঙ্গি আক্রান্ত কিনা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পজিটিভ হলে ধারণা করা হবে ওই বাড়ি ও আশপাশের মশার এডিস ভাইরাস আছে। এজন্য ফগিং, এডাল্টিসাইডং মশা মারা ও লার্ভিসাইডিংয়ের মাধ্যমে লার্ভা মেরে ফেলতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি, নাগরিকদের আচরণগত পরিবর্তন ও ডেঙ্গি পরীক্ষা বাড়াতে হবে। কলকাতা, দিল্লিতে এ পদ্ধতিতে সফলতা আসছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গি রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা চিকিৎসকরা যেসব সাধারণ উপসর্গ দেখি, এবার চিত্র কিছুটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। আক্রান্তরা অল্প জ্বরেও দু-একদিনের মধ্যে কাবু হয়ে যাচ্ছে। এবার যেহেতু ডেঙ্গি ও করোনা সংক্রমণ সমানতালে চলছে, তাই প্রথম পরামর্শ হলো জ্বরের শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। জ্বর অল্প, সমস্যা হবে না, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ডেঙ্গি রোগীর অবস্থা যে কোনো মুহূর্তে খারাপ হতে পারে। ফলে শেষ সময়ে হাসপাতালে এলেও চিকিৎসকদেরও কিছু করার থাকে না। জ্বর হলেই ডেঙ্গি টেস্ট করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, এ বছর সব বয়সিরা ডেঙ্গি আক্রান্ত হলেও প্রায় ২৫ শতাংশই শিশু। ডেঙ্গি নিয়ে শিশু হাসপাতালে অনেক মুমূর্ষু রোগী ভর্তি হচ্ছে। এদের মধ্যে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের পরিস্থিতি খুবই জটিল ছিল। অধিকাংশের হার্টের সমস্যা এবং কয়েকজনের পালমোনারি হিমোরেজ (রক্তক্ষরণ), ফুসফুস ও লিভারের সমস্যায় মারা গেছে।
সূত্র: যুগান্তর