সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৯০ হাজার পদে কোনো শিক্ষক নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এসব স্কুল, মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও কলেজের প্রতিটিতে গড়ে ৩ জন শিক্ষকের পদ শূন্য। এর মধ্যে ২৯ হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানেই আছে ৬৫ হাজার। বাকি পদগুলো এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকের ঘাটতি থাকায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। বিপরীত দিকে হাজার হাজার বেকার যুবক হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি অংশ কয়েক মাস ধরে জাতীয় জাদুঘর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে অনশনসহ আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে এনটিআরসিএ’র সচিব মো. ওবায়দুর রহমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ২০১৬ সাল থেকে তার সংস্থা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্যপদে নিয়োগের দায়িত্ব পেয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৮০৬৬৮ প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ তৃতীয় বিজ্ঞপ্তিতে ৩৪ হাজার এবং বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আরও ১৫ হাজার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এরপরও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে সারা দেশের এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান শূন্যপদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৬০ হাজারের কিছু বেশি পদে নিয়োগের লক্ষ্যে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্যপদ পূরণে ডিসেম্বরের দিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষক সংকট এখন অনেকটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তারা এনটিআরসিএ’র ভুল পদ্ধতিকে দায়ী করেছে। ২০১৬ সালের আগে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো। আর্থিক লেনদেন রোধে শিক্ষক নিয়োগ ক্ষমতা এ সংস্থাটির কাছে ন্যস্ত করে সরকার। তখন থেকে সংস্থাটি প্রতিবছর শিক্ষক নিয়োগ দিলে এভাবে এত পদ শূন্য থাকে না। গত ৬ বছরে মাত্র তিনটি নিয়োগ দিয়েছে।
এই নিয়োগের জন্য কোনো পরীক্ষা নেওয়ার দরকার হয় না। কেননা ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ১৬টি পরীক্ষা নিয়েছে সংস্থাটি। এতে সাড়ে ৬ লাখের বেশি প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আছে। সরকার অবশ্য সর্বশেষ এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে বয়স বেঁধে দিয়েছে ৩৫ বছর। নির্ধারিত বয়সি মোট প্রার্থী আছেন ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৮ জন। এদের মধ্যে অবশ্য অনেকে ইতোমধ্যে চাকরি পেয়ে গেছেন। ফলে এ ধরনের প্রার্থীর সংখ্যা সবমিলে ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো বলে সূত্র জানিয়েছে। তাই চাইলে নিয়োগ দিতে পারে এনটিআরসিএ।
নাম প্রকাশ না করে এনটিআরসিএ’র এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, নিয়োগ দিতে গিয়ে তারা প্রার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ স্বার্থান্বেষী মহলের নানান ধরনের ‘ভুল’র শিকার হচ্ছেন। ওই ভুলের কারণে সৃষ্ট কিছু ভুক্তভোগী উচ্চ আদালতে মামলা করেন। ওই মামলার নির্দেশনাও তাদের প্রতিপালন করতে হয়। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ভুল-প্রতিরোধক কিছু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। ফলে চাইলেও তারা দ্রুত করতে পারেন না নিয়োগ কার্যক্রম। দৃষ্টান্ত দিয়ে ওই কর্মকর্তা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পদের চাহিদা দিতে গিয়ে নানা ধরনের ভুল করে।
তাই চতুর্থ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার লক্ষ্যে চাহিদাপত্র নির্ভুল করতে জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার যাচাই প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর চাহিদাপত্র পাঠানোর শেষদিন থাকলেও এখনো ২০ জেলা তথ্য পাঠায়নি। এই তালিকা চূড়ান্ত করার পর তা আবার যাচাইয়ের জন্য তিন অধিদপ্তরে পাঠাতে হবে। এখন তারা যদি দ্রুত প্রতিবেদন বা অনাপত্তি না দেয়, তাহলে বিজ্ঞপ্তি ঝুলে থাকবে।
প্রার্থীরা জানান, সম্প্রতি চালু করা পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতিও জটিলতার পথ তৈরি করেছে। গত জানুয়ারিতে তৃতীয় বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের থেকে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু ৩৪ হাজার প্রার্থীর এই কর্ম নিয়ে জট লাগে। উপায়ান্তর না পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেরিফিকেশন চলমান রেখেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এখন পর্যন্ত গত ৮ মাসে মাত্র ৩৬ জনের ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পেয়েছে এনটিআরসিএ। আর বিশেষ বিজ্ঞপ্তির ১৫ হাজারের একজনের প্রতিবেদনও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, এই প্রক্রিয়া কতদিনে শেষ হবে।
শিক্ষক নেতারা বলছেন, এই নিয়োগে আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে, যে কারণে শূন্যপদ পূরণে বিলম্ব তো হচ্ছেই, পাশাপাশি নিয়োগের মাধ্যমেই হাজার হাজার পদও শূন্য করে ফেলে এনটিআরসিএ নিজেই। তারা জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলি ব্যবস্থা নেই। সীমিত বেতনে অনেকে দূর-দূরান্তে চাকরি করেন। ফলে যখনই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় এবং যাদের বয়স ৩৫-এর মধ্যে আছে, তারাও আবেদন করেন। সর্বশেষ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যে ৩৪ হাজার নিয়োগ পান তাদের মধ্যে ইনডেক্সধারী বা আগে থেকে চাকরি করা প্রার্থীই ২১৮৭৩ জন বা দুই-তৃতীয়াংশ। বাকি ১৪৬৬৭ জন নতুন সুপারিশপ্রাপ্ত। অর্থাৎ পুরোনোরা ফের যোগদান করায় সমসংখ্যক পদ প্রকারান্তরেই খালি হয়ে যায়।
এনটিআরসিএ সচিব এই বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, চাকরির বয়স থাকায় চাইলেও তাদের বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এমপিওভুক্ত এবং এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানে আবেদনের ইস্যুতে কিছু জটিলতা হয়ে থাকে। এবারে সেটি আমলে নিয়ে এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো চাহিদাপত্র নেওয়া হয়নি। এতে নিয়োগপ্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ হবে এবং কাজ দ্রুত হবে। ফলে নতুন বিজ্ঞপ্তি দ্রুত দেওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, ‘এটা ঠিক যে, যদি পুরোনো চাকরিপ্রার্থীদের (ইনডেক্সধারী) আমরা আলাদা করতে পারতাম, তাহলে চাকরি দেওয়া কোনো লোকই খুঁজে পেতাম না।’