দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে যাচাই করা হচ্ছে বিভিন্ন নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের সুফল। কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের আগে সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অর্থ বরাদ্দ বিবেচনায় সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। তবে শুধু সিসি ক্যামেরা বসানোয় সমাধান দেখছেন না নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবহার করা হয় ৮৫০টি সিসি ক্যামেরা। প্রতি ভোটকেন্দ্রে দুটি করে মোট ২০৪টি, প্রতি ভোটকক্ষে একটি করে মোট ৬৪০টি এবং অন্যান্য স্থানে ছয়টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এভাবে ভোট পর্যবেক্ষণ করা হয় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন থেকে। ইসি কর্মকর্তাদের দাবি, এ কারণে সহিংসতা এড়ানো গেছে। কেন্দ্র নিয়ে অভিযোগের সুযোগ পায়নি কোনো পক্ষ। বর্তমানে বিভিন্ন ভোটে ব্যবহার করা হচ্ছে সিসি ক্যামেরা। সার্বিক বিবেচনায় যে কোনো ধরনের অভিযোগ, বিশৃঙ্খলা এড়াতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা করছে ইসি।
এ বিষয়ে ইসির আইডিয়া প্রকল্প-২ এর ডিপিডি কমিউনিকেশন অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার মো. শাহরিয়ার আলম জাগো নিউজকে বলেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত নয়। বিগত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন স্বচ্ছ করতে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। এতে সুফল মিলেছে। সেই ভোটে যেসব অভিযোগ এসেছিল, সেগুলোর কিন্তু প্রমাণ সিসি ক্যামেরার ফুটেজে মেলেনি।
সুতরাং, সংসদ নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারে ভোট নিয়ে যেসব অভিযোগ আসে সেগুলোর অনেকটা সমাধান মিলবে। এক্ষেত্রে কেউ কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা করার সাহস পাবে না। ‘আমরা এখন বিভিন্ন নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করছি। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে কমিশন যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সংসদ নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার হতে পারে।’
সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ, ফাইল ছবি
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রথমে ৩০০ আসনে ৪০ হাজার ৬৫৭টি সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্রের তালিকা করা হয়। তবে গাইবান্ধা-৩ আসনের একজন প্রার্থী মৃত্যুবরণ করায় সেখানকার ভোট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোটকেন্দ্রের ২ লাখ সাত হাজার ৩১২টি ভোট কক্ষে ভোটগ্রহণ করা হয়। সেবার ভোটার ছিল ১০ কোটি ৪২ লাখ। সেটি বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ১১ কোটি ৩২ লাখের বেশি। চলমান হালনাগাদ শেষে ভোটার আরও বাড়বে।
সার্বিক বিবেচনায় বাড়বে ভোটকেন্দ্র এবং ভোটকক্ষের সংখ্যাও। ফলে শুধু ভোটকক্ষে ব্যবহার করলেও সিসি ক্যামেরা লাগবে প্রায় সোয়া দুই লাখ। আর কুমিল্লা সিটির মতো প্রতি কেন্দ্রে এবং কক্ষে আলাদাভাবে ব্যবহার করলে লাগবে আড়াই লাখের বেশি। কমিশনের সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিসিটিভি তো একটা উপায়।
এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ সাইদের ভাষায় ‘দুষ্টু লোক’, তারা দুবার চিন্তা করবে কোনো দুষ্টামি করার ক্ষেত্রে। সিসিটিভি ফুটেজ যদি সংগ্রহে রাখা যায়, অবশ্যই এটি একটি শক্ত সাক্ষ্য। কিন্তু বিপথগামীরা বিভিন্ন ঘটনায় সিসিটিভিগুলো ভেঙে ফেলেন, যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে। যারা তস্কর, তারা প্রথার বিপরীত চিন্তা করে এবং একটা সমাধান বের করে ফেলে। তাই যে কোনো আইডিয়া করেন না কেন তার সুফল যাতে না পাওয়া যায় সেজন্য যারা তস্কর তারা অভিনব পন্থা আবিষ্কার করেবে। সে বিষয়ে কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, সার্বক্ষণিক সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। সবচেয়ে বড় ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করতে পারে জনগণ। তারা যদি সচেতন হন, ‘বোকামি না করেন, মিষ্টি কথায় বিমোহিত হয়ে ভুলে না গেলে এটি সম্ভব। এ ব্যাপারে কমিশনকে উদ্যোগী হতে হবে। নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে ২৪ ঘণ্টা, ৩৬৫ দিন কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। শুধু ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত রাখলে চলবে না।’ তবে কমিশনের এই চিন্তায়ও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এসব (সিসি ক্যামেরা) হলো লোক দেখানো।
তারা যদি ইভিএম ব্যবহার করে এবং নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়, তাহলে কী হবে আমরা জানি। যেটা ঘটেছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটে। আসলে এসব গুরুত্বহীন। ওখানে তখন গুরুত্বপূর্ণ হলো যারা ক্ষমতায় থাকে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পক্ষেই কাজ করবে, যেমন ২০১৮ সালে হয়েছে। আর ইভিএম হলে নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল দেবে সেটাই ফাইনাল। সিসিটিভিতে কি দেখা যাবে যে তারা ইভিএম ম্যানিপুলেট করে রেখেছে? সিসিটিভিতে দেখা যাবে যেটা, সেটা হলো কেউ যদি এসে মারামারি করে সেসব। এ সবই লোক দেখানো।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা ব্যবহারে আমাদের তো ইচ্ছা আছেই। আমরা যদি কেন্দ্রের মনিটরিং রাখতে চাই এবং সন্ত্রাসী, ভোট ডাকাতি এসব নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে সিসি ক্যামেরার প্রয়োজন। আমরা ভোটের কাছাকাছি গিয়ে আমাদের ফান্ডের প্রাপ্যতা, প্রয়োজনীয়তা সবকিছু মিলিয়ে দেখবো। তিনশ আসনের যে হিউজ ফান্ড দরকার, আমরা পারলে করবো না হলে ঝুঁকিপূর্ণগুলোতে করতে হবে।’
‘একেকটি সিসিটিভি যদি আমি সেন্ট্রালি কন্ট্রোল করি, তিনদিনের জন্য কত ব্যান্ডউইথ খরচ হবে সেটিও দেখতে হবে। আমরা তো ঢাকা থেকে মনিটর করবো। তবে দেড় বছর আগে বলা যাচ্ছে না। পরিবেশ পরিস্থিতি কোনদিকে যায়, কেমন যায়… সবকিছুই আছে। আমরা ফাইনাল সিদ্ধান্ত পরে নেবো। এখনো যেসব নির্বাচন হচ্ছে, সিটি করপোরেশন থেকে পৌরসভা সবগুলোয়ই সিসিটিভি দিচ্ছি।’ সূত্র: জাগোনিউজ