বাংলাদেশের ইতিহাসে জ্বালানি তেলের দাম এখন সর্বোচ্চ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ব বাজারের অস্থিরতায় বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম একবারে বাড়ে ৪০ শতাংশের বেশি। সংকট উত্তরণে বিকল্প উৎস সন্ধান অব্যাহত। কিন্তু সেখানে বাধা আমাদের রিফাইনারির সক্ষমতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের একমাত্র রিফাইনারিটি অনেক পুরোনো।
এটা আধুনিক করলে সিস্টেম লস কমবে। কমে আসবে মোট উৎপাদন খরচ। তখন কম দামেই জ্বালানি তেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রুড অয়েল কিনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে দাম বাড়ার অন্যতম কারণ রিফাইন খরচ। অন্যান্য দেশের তুলনায় রিফাইন খরচ বেশি হওয়ায় দেশের বাজারে তেলের দামও বেশি পড়ছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে ডিজেল বিক্রি হয়েছে ৩৪টি দেশে। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, রাশিয়া, তাইওয়ান, সিরিয়া, ওমান, কাতার, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, মিশর, কুয়েত, আলজেরিয়া, সৌদি আরবের মতো দেশ। সবচেয়ে কম দামে দেশের মানুষকে তেল দিচ্ছে ইরান। এসব দেশের মধ্যে অনেকেই নিজেরা তেল উৎপাদন করছে, আবার অনেকে বাংলাদেশের মতোই আমদানি করেও কম দামে তেল সরবরাহ করছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো থেকে জানা যায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে একপর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলার হয়ে যায়। আগস্টের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ক্রুড অয়েলের দাম ৮৬ ডলারেরও নিচে আছে।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেল নিয়ে কাজ করেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অব টেকনোলজির (এমআইএসটি} সহযোগী অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. আমিরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রুড অয়েল কিনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে দাম বাড়ার অন্যতম কারণ রিফাইন খরচ।
অন্যান্য দেশের তুলনায় রিফাইন খরচ বেশি হওয়ায় দেশের বাজারে তেলের দামও বেশি পড়ছে। দেশের একমাত্র রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড পুরোনো ও দুর্বল হয়ে পড়ায় রিফাইনারিতে অনেক টাকার ক্রুড নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে। ফলে ক্রুড বেশি আমদানি করেও তেল কম পাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে দাম।
আমাদের একটা রিফাইনারি সত্যিই প্রয়োজন। যেটাতে আমরা রিফাইন করছি, এটার বয়স তো কম হলো না।- ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান হোসেন
তার দেওয়া তথ্যমতে, ক্রুড অয়েল কিনে রিফাইনিংসহ বছরে ডিজেলের আমদানি খরচ পড়ে ৫৯ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, জেট ফুয়েলের আমদানি খরচ পড়ে ৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, অকটেন ও পেট্রলের আমদানি খরচ পড়ে ৫ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের আমদানি খরচ পড়ে ২ হাজার ২৫৬ দশমিক ৬ কোটি টাকা। মোট আমদানি খরচ ৭১ হাজার ৭৮৬ দশমিক ৬ কোটি টাকা।
তিনি আরও জানান, একটি আধুনিক রিফাইনারিতে এক ব্যারেল (১৫৯ লিটার ) ক্রুড অয়েল কেনা ও রিফাইন করতে খরচ পড়ে বাংলাদেশি টাকায় ১০ হাজার ৫শ টাকা। যেখান থেকে ডিজেল হয় ১২৭ লিটার বা ব্যারেলের ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে অকটেন, পেট্রল, কেরোসিন, জেট ফুয়েল পাওয়া যায় ৩২ লিটার, যা ২০ শতাংশ। খরচ হিসাব করলে ডিজেলের উৎপাদন খরচ পড়ে মাত্র ৬০ টাকা প্রতি লিটার। অন্যদিকে অকটেন, পেট্রল, কেরোসিন, জেট ফুয়েলের উৎপাদন খরচ পরে ৯০ টাকা প্রতি লিটার।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, একটি আধুনিক রিফাইনারির সঙ্গে যদি ইস্টার্ন রিফাইনারির তুলনা করি, তাহলে দেখি এক ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ক্রুড অয়েল কেনাসহ রিফাইন করতে খরচ পড়ে ১০ হাজার ১৬০ টাকা। এর মধ্যে আবার ডিজেল হয় মাত্র ৪১ থেকে সর্বোচ্চ ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৭৪ লিটার। অন্যদিকে অকটেন, পেট্রল, কেরোসিন,
জেট ফুয়েল, বিটুমিন ও ফার্নেস অয়েল হয় ৪২ লিটার, যা ব্যারেলের ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যারেলের বাকি ৪৩ লিটার রিফাইনারির অক্ষমতার কারণে অপচয় হয়, যা ২৭ শতাংশ। এই ২৭ শতাংশ অপচয়ের কারণে এর খরচ বাকি ৭২ শতাংশের ওপর গিয়ে পড়ে। এতে ডিজেলের উৎপাদন খরচ পড়ে ১২০ টাকা প্রতি লিটার। অকটেন, পেট্রল, জেট ফুয়েলের উৎপাদন খরচ পড়ে ১৩০ টাকা প্রতি লিটার।
সূত্র জানায়, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল রিফাইন করা হয়। এর মধ্যে ন্যাপথা উৎপাদন হয় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬১ টন বা ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। রিফাইনারিতে মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার ২৫৬ লাখ টন ক্রুড অয়েল অপচয় হয়, যার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, একটা আধুনিক রিফাইনারি স্থাপন করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো, যা এখন জরুরি। শুধু রিফাইনারিতে অপচয়ের কারণে আমাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের একটা রিফাইনারি সত্যিই প্রয়োজন। যেটাতে আমরা রিফাইন করছি, এটার বয়স তো কম হলো না।
ইআরএল-২ হলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১২ সালে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেটা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সেটি হলে আমাদের অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে। সেখানে শুধু অ্যারাবিয়ান লাইট বা মারবান ক্রুড নয়, ওই সমমানের যত ক্রুড যেখান থেকেই আসুক, যেন রিফাইন করা যায়, সেভাবেই কাজ করা হচ্ছে।
তেল অপচয় বা লস হচ্ছে এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লস বলতে বিষয়টা তেমন না। আমরা তো পুরাতনটায়ও অনেক কাজ করেছি। সেটা এখন আমাদের মোটামুটি শতভাগ রিফাইন দিচ্ছে। আমাদের নতুন ইউনিট যেটা হচ্ছে সেটা এখান থেকেই আপডেট হবে। ইআরএল-১ এ যেটা পরিশোধন হয় না, সেটাই ইউনিট-২ এ পরিশোধন করা হবে। আবার দ্বিতীয় ইউনিটের অনেক কিছু নিয়ে পুরাতনটাও কাজে লাগানো হবে।
ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, নতুন যে রিফাইনারি হচ্ছে, এটিকে ইউনিভার্সেল রিফাইনারি না করায় তেমন ফলপ্রসূ হবে না। একটি আধুনিক রিফাইনারিতে পৃথিবীর যে কোনো ক্রুড অয়েল পরিশোধন করা যাবে। এমনকি রাশিয়ার ক্রুড অয়েলও পরিশোধন হবে, যেটি পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতসহ দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভেনেজুয়েলা, আমেরিকা, সৌদি আরব ও অন্য দেশগুলো করছে।