রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : চীন কেন এখন মধ্যস্থতা করতে চায়?

ইউক্রেনের সংঘাতের অবসানের লক্ষ্যে চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে চাইছে। এরই মধ্যে ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে দেশটি। সে পরিকল্পনায় দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা, দুই দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো ও হানাহানি বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এতদিন পুতিনকে সমর্থন জানিয়ে আসলেও, এখন কেন চীন যুদ্ধ থামাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে চাচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি চীনের এ পদক্ষেপের কিছু কারণ বিশ্লেষ করেছে। আসুন দেখি, বিবিসি কী বলছে।

ইউরোপের মন জয়ের চেষ্টা?

বিবিসি সংবাদদাতা টেসা ওয়ংয়ের মতে, গত এক বছরে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চীনের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেছে। সেসময় না হলেও, বেইজিং এখন সে বিষয়ে সবচেয়ে সবল প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। বিষয়টি অনেক পশ্চিমা দেশের পছন্দ নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র ইউরোপ সফরের মধ্য দিয়ে চীন সবার মন জয় করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। অবশ্য সে সফর শেষ হয়েছে মস্কোতে ওয়াংকে ভ্লাদিমির পুতিনের উষ্ণ অভ্যর্থনায় মধ্য দিয়ে।

ইউক্রেন প্রশ্নে চীন মূলত একটি নয়, দুটি অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে। প্রথমটি, যুদ্ধের অবসানে চীনা সমাধানের প্রস্তাব। অন্যটি হলো, বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন। এসব বিষয় মূলত চীনের একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি। এক বছর ধরে চীনা নেতারা এসব কথাই বলে আসছেন। এতে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান ও রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করা। এসব বিষয় পশ্চিমা দেশগুলোকে হয়তো খুশি করবে না। অবশ্য পশ্চিমা মোড়লদের খুশি করা কখনই চীনের প্রধান লক্ষ্য ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘সুস্পষ্ট বার্তা’

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের লক্ষ্য হচ্ছে প্রথমত, বিশ্বের শান্তিরক্ষক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করা। তারা আসলে কাকে দলে টানতে চাইছে সেটার সুস্পষ্ট ইংগিত রয়েছে। তাদের একটি দলিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা – তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের মাধ্যমে চীন বিশ্বের বাদবাকি দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। এখন তারা নজর রাখছে পশ্চিমা দেশগুলো কীভাবে ইউক্রেন সংকট মোকাবিলা করে তার ওপর।

চীনের আরেকটি মূল লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠানো। যুক্তরাজ্যের নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির চীন-রাশিয়া সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড. আলেকজান্ডার কোরোলেভ বলছেন, এর মধ্যে বিরুদ্ধাচরণের স্পর্ধা দেখানোর একটি ব্যাপারে রয়েছে। ‘‘এসবের মাধ্যমে চীন বলতে চাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সীমা অতিক্রম করে, তাহলে তাদের সমর্থনের জন্য শক্তিশালী মিত্র রয়েছে। ‘রাশিয়া একা নয়’, বলার মানে হল কখনো যদি চীনকে যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে তারাও একা থাকবে না। তাই হুমকি-ধমকি দিয়ে কোনো লাভ নেই।’’

চীনের কাছে নেতৃত্বের সুযোগ

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তিক্ত। সম্প্রতি ‘গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ড’ নিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চীন কেন ঠিক এ সময়েই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। ড. কোরোলেভ বলছেন, নেতৃত্ব দেখানোর জন্য চীনের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রথম দিকেই তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যদি চীন নিজেকে সত্যিই বিশ্বনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইতো, তাহলে যুদ্ধের প্রথম দিকেই ভূমিকা রাখতো। এতদিন পর্যন্ত দর্শক হিসেবে বসে থাকতো না।

বিবিসি বলছে, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরির মতো যে দেশগুলো রাশিয়ার প্রতি কম কট্টরপন্থী বলে চীন বিশ্বাস করে, সম্প্রতি শুধু সেসব দেশ সফর করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হয়তো তিনি দেখতে চাইছেন, ইউরোপের কিছু অংশকে চীনা বলয়ের দিকে টেনে নেওয়া যায় কি না। পশ্চিমা দেশগুলোর দাবি, চীন সরকার একদিকে মস্কোকে সমর্থন, অন্যদিকে নিজেকে নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে চীন, ভারত ও বাংলাদেশসহ ৩২টি দেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *