মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাকের অর্ডার বাতিল করছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। টার্গেট, ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠান এবার শিক্ষার্থীদের ‘স্কুলে ফেরা’ মৌসুমে কাক্সিক্ষত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। অবশ্য কী পরিমাণ অর্ডার বাতিল হয়েছে, তা হিসাব করতে পারেনি তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় চলতি অর্থবছরে ওয়ালমার্টের গুদামে অবিক্রীত পণ্য ২৬ শতাংশ বেড়েছে। সে তুলনায় বিক্রি বাড়েনি। এতে তারা বিপাকে পড়েছে। একই ধরনের সংকটে পড়েছে ওয়ালমার্টের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি টার্গেট করপোরেশন। তাদের অবস্থা ওয়ালমার্টের চেয়েও খারাপ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, তৈরি পোশাকশিল্প এখন চরম দুঃসময় কাটাচ্ছে। করোনার কারণে দুই বছর অর্ডার কম ছিল। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বড় ধাক্কা দিয়েছে। এ যুদ্ধের নানামুখী প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে। যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির আঘাত মোকাবিলায় সবার আগে পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ও জাহাজ ভাড়া কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের দাম ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এতে পণ্যের উৎপাদন থেকে প্রায় প্রতিটি ধাপে বেড়েছে খরচ, যা শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা হ্রাস করছে। তার ওপর করোনার শুরুতে শ্রমিকদের জন্য দেওয়া প্রণোদনার অর্থের সুদ কেটে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে চলমান প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাকশিল্প টিকে থাকাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। তারা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ‘ব্যাক টু স্কুল’ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পণ্য বিক্রি হয়। এ সময়ে গ্রীষ্মের লম্বা ছুটি কাটিয়ে সব শিক্ষার্থী স্কুলে ফেরে। অভিভাবকরাও শিশুদের নতুন পোশাকসহ অন্য সব পণ্য কিনে দেন। এ সময় অভিভাবকরা বিভিন্ন ধরনের মূল্যছাড় খোঁজেন। মূলত সেই সুযোগ কাজে লাগায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমিয়েছেন পোশাক কেনা।
এ বিষয়ে নিট পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, তৈরি পোশাক খাত কঠিন সময় পার করছে। ওয়ালমার্ট তো ঘোষণা দিয়ে অর্ডার কমিয়েছে, অন্যকিছু প্রতিষ্ঠান ঘোষণা ছাড়াই অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। অনেক কারখানায় পণ্য ফাইনাল পরীক্ষা শেষে কার্টনবন্দি অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ক্রেতার নির্দেশের অপেক্ষায় শিপমেন্ট করতে পারছে না। ৫-৬ মাস আগেও যে পরিমাণ অর্ডার আসা শুরু করেছিল, এখন চিত্র পুরোই উলটো। অর্ডার দিয়েও পণ্য নিচ্ছে না ক্রেতারা।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে অর্ডারে। গত মাসের চেয়ে চলতি মাসে রপ্তানি ৫০ কোটি ডলার কম হবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আগামী ৩-৪ মাস পর অর্ডারের অবস্থা কেমন থাকবে, তা নিয়েই ভাবতে শুরু করেছেন রপ্তানিকারকরা। বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতাদের মধ্যে ওয়ালমার্ট অন্যতম। বিক্রি কমে যাওয়ায় তারা অনেক অর্ডার ড্রপ করছে বা পরবর্তী সময়ে নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করছে। মাস শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির প্রকৃত তথ্য জানা যাবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৬৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয় ৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৬৫ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে। আর তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে ৫১ কোটি ডলার। একইভাবে স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি এবং পোল্যান্ডের মতো প্রধান দেশগুলোয় পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে।