ভূমিকম্পে কেন মৃত্যুপুরী তুরস্ক-সিরিয়া?

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল আর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অল্প সময়ের ব্যবধানে সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। হাজার হাজার ভবন সমতলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে এই দুর্যোগ। বিভিন্ন শহরের বাসিন্দারা আটকা পড়ে যান ধসে পড়া ভবনের ভেতরে। ধারাবাহিকভাবে আফটারশকের পর আবারও দু’দফায় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে তুরস্কে। এখন পর্যন্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের কারণে নিহত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি মানুষ।

আহত হয়েছেন আরও অনেকে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, ‘এক শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে তার দেশ।’ কিন্তু ভূমিকম্প কেন এতো মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালো? ভূমিকম্পের হাত থেকে মানুষগুলোকে বাঁচানোর কি কোনো উপায় ছিল? এ রকম হাজারো প্রশ্ন ভিড় করছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মনে।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূত্বকের টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়ার কারণে ভূমিকম্প হয়। প্লেটগুলোর আকার পরিবর্তিত হয়। দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে আছে ফল্ট লাইন। ভূমিকম্প সাধারণত এই ফল্ট লাইনের আশপাশে হয়ে থাকে। টেকটোনিক প্লেটগুলো ধীরে ধীরে সরে যায় এবং কখনও কখনও সঙ্গে লেগে থাকে আবার কখনও ফল্ট লাইনে কম্পন তৈরি করে। যখন এটি খুব বেশি বৃদ্ধি পায়, তখনই ভয়াবহ ভূ-কম্পন্ন অনুভূত হয়। যেটি তুরস্ক-সিরিয়ায় ঘটেছে।

তুরস্ক হলো প্রবল ঝুঁকিপ্রবণ দেশ। তুুরস্কের বেশিরভাগ অংশ আনাতোলিয়ান প্লেটে। এটি আবার দুটি প্রধান প্লেটের মধ্যে রয়েছে। একটি ইউরেশিয়ান ও আফ্রিকান এবং অপরটি দক্ষিণ-পূর্বে আরবীয় প্লেট, যেটি উত্তর-পশ্চিমে চাপ দিচ্ছে। উত্তরে রয়েছে অনেক বড় ইউরেশিয়ান প্লেট, যা সরে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্বে। এই বড় দুটি প্লেট স্থানান্তরিত হওয়ার সময় শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি হয় এবং তুরস্ক সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।

ভূমিকম্প একটি সাধারণ ব্যাপার। তবে বেশ কিছু জিনিস এই ভূমিকম্পের কারণে ক্ষয়ক্ষতি আরও প্রবলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনিতেই এটি ভয়াবহ ছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এরপর আরও একটি শক্তিশালী ৭ দশমিক ৫ মাত্রার আফটারশক হয়। যেখানে গড়ে বছরে ৭ মাত্রার চেয়েও শক্তিশালী ১৫টি ভূমিকম্প হয় সেখানে।

ভূমিকম্পে কেন মৃত্যুপুরী তুরস্ক-সিরিয়া?

মাটির ওপরের অবকাঠামোগত ফ্যাক্টরগুলো পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। প্রথম দফায় ভূ-কম্পনটি রাতে ঘটে, যখন লোকজন বাড়ির ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাদের পালানোর খুব একটা সুযোগ ছিল না। ঠান্ডা আবহাওয়া ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া এবং বেঁচে থাকা লোকজনের জন্য শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বছরের পর বছর যুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। যদিও আবহাওয়াবিদরা হারিকেন বা বন্যার মতো দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে পারেন। তবে সিসমোলজিস্টরা এখনও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস করতে পারেন না (যদিও এটি গবেষণার একটি সক্রিয় ক্ষেত্র)।

এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কেও সাধারণ এর প্রকোপ প্রতিরোধ করার জন্য ভবন নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু অনেক ইমারত এই ধরনের নিয়ম চালু হওয়ার আগে থেকেই আছে। তা ছাড়া দুর্নীতির কারণে প্রায়শই নিয়ম অমান্য করেন ভবন নির্মাতারা এবং গড়ে তোলেন বড় বড় ইমারত। প্রস্তুতি আরও বাধাগ্রস্ত হওয়ার বড় কারণ হলো ঝুঁকিপূর্ণ স্পটেও বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঘটনা বিরল। এক শতাব্দীরও আগে, আধুনিক মনিটরিং সিস্টেমের আবির্ভাবের পর থেকে পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট এই আকারের ভূমিকম্পের রেকর্ড করেনি।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *