তুরস্কের মেগাসিটি ইস্তাম্বুল। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বৃহত্তম নগরী, প্রধান সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্র এটি। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এবার ইস্তাম্বুলকে শক্তিশালী ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। কেননা যা যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে এবারের ভূমিকম্প। আল-জাজিরার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, তুরস্কের এই নগরী ভূমিকম্পের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শহর কাহরামানমারাস থেকে ৭ দশমিক ৮ ও ৭ দশমিক ৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে অন্তত ১০টি শহরে। এতে ৩১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৮০ হাজারের বেশি মানুষ। জোড়া ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে ১০টি শহরের বড় বড় ভবনগুলো। এই ভূমিকম্প আঘাত হানে সিরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় তুরস্ক ও সিরিয়ার। ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তুরস্কের এই ব্যবসা ও পর্যটনকেন্দ্রিক রাজধানীতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের আসন্ন হুমকির মধ্যে রয়েছে এই শহর।
ইস্তাম্বুলের ইলদিজ টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুকরু ইরসয় আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ভূতাত্ত্বিক যে তথ্য আছে তা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, যেকোনো সময় ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্প হতে পারে। অতীতের ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, মারমারা সাগরের নিচে, কাছাকাছি একটি ফল্ট লাইন রয়েছে। আমরা গবেষণার মাধ্যমে জানি, উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন প্রতি বছর কতটা নড়াচড়া করে। ফল্ট লাইনের গতিবিধি ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, তবে এটি কখন ঘটবে তা সঠিকভাবে জানা অসম্ভব।’
চেম্বার অব জিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের চেয়ারম্যান হুসেইন অ্যালান তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ইস্তাম্বুলে ৭ মাত্রার বা তারও বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে।’ ইরসয় ব্যাখ্যা করে আরও বলেন, ‘মারমারা সাগরের নিচের ফল্ট লাইনটি এক বছরে ৭ মাত্রার চেয়েও শক্তিশালী দুটি ভূমিকম্প সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। আমরা ১৯৯৯ সালে কোকেলি এবং দুজসে ভূমিকম্পের আঘাত, সেই সঙ্গে অতীতে এই অঞ্চলের অন্যান্য ভূমিকম্পে এটি লক্ষ্য করেছি।’
১৯৯৯ সালের আগস্টে তুরস্কের মারমারা অঞ্চলের পশ্চিম অংশে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং সাড়ে ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সে বছরের নভেম্বরে আরেক দফায় ভূমিকম্পে আরও ৮৪৫ জনের মৃত্যু হয়। তুরস্ক এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে বেশ কয়েকটি টেকটোনিক প্লেট রয়েছে এবং প্লেটের মধ্যকার সীমানা ঘিরে ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা অনেক বেশি। উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন ইউরেশিয়ান ও আনাতোলিয়ান প্লেটকে বিভক্ত করে এবং এটি ইস্তাম্বুলের দক্ষিণে মারমারা সাগরের মধ্য দিয়ে গেছে।
তুরস্কের সরকারি তথ্য বলছে, ইস্তাম্বুল ২০২১ সালে মোট দেশীয় পণ্যের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ উৎপাদন করেছিল। যেটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। শক্তিশালী আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত করলে শিল্পখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইরসয় বলেছেন, ইস্তাম্বুলসহ দেশের অন্যান্য শহরে ভয়াবহ ভূমিকম্পের আভাস কর্তৃপক্ষের এজেন্ডার শীর্ষে থাকা উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখনই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত এবং দ্রুত শুরু করা উচিত। একই সঙ্গে ইস্তাম্বুলকে ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত করার জন্য সমস্ত সংস্থাকে একত্রিত করা উচিত।’
অপরদিকে, হুসেইন অ্যালান বলেন, ‘ইস্তাম্বুলের একটি ভূমিকম্প সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। শহরের সরকারি অফিস, হাসপাতাল, সামরিক ঘাঁটি এবং ফায়ার সার্ভিস ভবনগুলো সেভাবে প্রস্তুত করা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের ভূমিকম্পে, হাসপাতাল ও জরুরি সার্ভিস ইউনিটসহ অনেক রাষ্ট্রীয় ভবন ধসে পড়েছে। ভূমিকম্পে বিমান, সড়ক ও রেলপথের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী ঘটে তা আমরা দেখেছি। ফলে ওই অঞ্চলে দ্রুত সাহায্য পৌঁছাতে পারে না।’
অ্যালান বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ইস্তাম্বুলের নগর রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে হবে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিও গুরুত্ব দেন তিনি।’ ১৯৯৯ সালের মারমারা ভূমিকম্পের পরে দেশটির নির্মাণ বিধিগুলো আরও নতুন করে করা হয়। এতে তুরস্কের সিসমিক ডিজাইন কোড নতুনভাবে সাড়া ফেলেছিল। এ ছাড়াও, তুরস্ক সরকার পুরোনো ভবনগুলোকে নতুন করে প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি শহর রূপান্তর প্রকল্পও চালু করেছিল। গত সপ্তাহের ভূমিকম্পের সময়, কিছু নবনির্মিত ভবন ধসে পড়ে। এতে অভিযোগ উঠে, এসব ভবন নির্মাণে সঠিক নিয়ম মানা হয়নি।
ইরসয় বলেছেন, তুরস্কের নির্মাণখাতে দুর্নীতি বেশি এবং কিছু ভবন পরিদর্শনেও বিষয়টি ধরা পড়ে। অন্যান্য অঞ্চল থেকে অভিবাসনের কারণে গত কয়েক দশকে ইস্তাম্বুলে মানুষ বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে শহরটির পরিধি। জমি কমে যাওয়ার কারণে নির্মাণ কোম্পানিগুলো চাহিদা মেটাতে উঁচু উঁচু ভবন তৈরি করছে। মারমারা সাগরের তলদেশে যে ভূমিকম্প হতে পারে সেকারণে এই উঁচু ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেশটির পরিসংখ্যান বলছে, ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর শেয়ার করা তথ্যমতে, শহরের প্রায় ৯০ হাজার ভবন ভূমিকম্পের কারণে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থায় রয়েছে। অপরদিকে, ইস্তাম্বুল মেট্রোপলিটন পৌরসভার গবেষণার তথ্য বলছে, আরও ১ লাখ ৭০ হাজার ভবন ‘মাঝারি-ঝুঁকির’ তালিকায় আছে।
ইরসয় বলেছেন, ‘ভূমিকম্প একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। যে কোনো সরকারকে তাদের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব কমাতে প্রস্তুত থাকতে হবে। যখন কোনো দেশ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তাদের বিনিয়োগের উদ্যোগ জঞ্জাল হয়ে যায়। যেমন একটি গাড়ির চাকা কাদায় আটকে থাকে, ঠিক সেরকম। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং ভূমিকম্পের আগেেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।’