বাংলাদেশের রিজার্ভ আসলে কতো? : রুমিন ফারহানা

মাত্রই ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছে দেশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রকৃত ক্ষতির প্রতিবেদন পেতে নাকি ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। তবে এর মধ্যেই সরকারিভাবে যে খবর পাওয়া গেছে সেটি অনুযায়ী সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ইউনিয়নে আনুমানিক ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৬ হাজার হেক্টর ফসলের জমি নষ্ট হয়েছে এবং ১ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এর মধ্যে ঝড়ের তাণ্ডবে মারা গেছেন ২১ জন।

দুর্যোগ, ঝড়ো হাওয়া ও তুমুল বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ ছিল। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিল বহু মানুষ। কিন্তু সেখানে খাবার, পানি, টয়লেটসহ সমস্যার অন্ত নেই। যদিও সিত্রাং আগেভাগে ঘোষণা দিয়েই এসেছে, তারপরও আর সব বারের মতোই প্রস্তুতিহীন ছিল আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। যেহেতু খুবই সাধারণ মানুষ ঠাঁই নেয় এই কেন্দ্রগুলোতে, তাই তাদের বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হলেও চলে সরকারের। গত ১৫ বছরে অন্তত তাই দেখেছি আমরা।

অবশ্য এ দেশে গত ১৫ বছরে সরকার সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যা নিয়েই বা মাথা ঘামিয়েছে? প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক কিংবা মানবসৃষ্ট, সাধারণ মানুষের দুর্দশায় কখনোই পাওয়া যায়নি সরকারকে। এই যেমন কয়েক মাস আগেই যখন বন্যার পানিতে ভাসছিল সিলেট, তখনো দেখেছি সরকারের উদাসীনতা। আগাম ঘোষণা দিয়ে আসার পরও দেখা গেছে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর তেমন কোনো প্রস্তুতিই ছিল না সরকারের তরফে। সিলেট আর সুনামগঞ্জের বন্যায় প্রাথমিকভাবে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৬০ লাখ টাকা যেখানে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৫০ লাখ।

অর্থাৎ মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল ১ টাকা ২০ পয়সা। সেই সময় যখন ডুবছিল মানুষ, ভাসছিল পানিতে, হাহাকার করছিল সহায় সম্বল হারিয়ে তখন দেখেছি বরিশালে জয়বাংলা কনসার্টের বিশাল আয়োজন। সরকারি দলের এক অতি প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও সাংসদ চার্টার্ড বিমানে চড়ে সেখানে গিয়ে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনিয়ে এসেছিলেন। কনসার্টের নাচ, গান আরও বেশি উপভোগ্য করার জন্য ভারতীয় শিল্পী মিমি চক্রবর্তীকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল ভারত থেকে। সে বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কত খরচ হয়েছে সে হিসাব আর জানা যায়নি।

করোনার সময়ও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। সরকারি প্রেসনোট অনুযায়ী করোনার প্রথম লকডাউনের ৩ মাসে একজন মানুষ গড়ে চাল পেয়েছিল ২.৬২ কেজি। প্রতিদিনের হিসাবে এর পরিমাণ ১৪.৫৫ গ্রাম। ৩ মাসে আর্থিক সাহায্য পেয়েছিল ২০.৫৮ টাকা, প্রতিদিনের হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১.৩৮ পয়সা। একজন প্রান্তিক মানুষ প্রতিদিন ১৪ গ্রাম চাল আর ১১ পয়সা দিয়ে কি করবে সে আলাপ তুলেই রাখি। কথায় কথায় সিঙ্গাপুর, ইউরোপ হওয়া সরকার কেন যেন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে পাশে দাঁড়ানোর সময়টাতেই ভীষণ কৃপণ হয়ে ওঠে।

অথচ এই সরকারই যখন মেগা প্রকল্প বা অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলে তখন ন্যূনতম কোনো আর্থিক সংকটের আভাস পাওয়া যায় না। আসলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে পাশে দাঁড়ানোর ঠেকা সরকারের নাই। ক্ষমতায় আসতে কিংবা ক্ষমতায় থাকতে মানুষের ম্যান্ডেট তাদের লাগে না। কিন্তু বড় বড় প্রকল্পের অবিশ্বাস্য বরাদ্দ আর ঋণ থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া যায় সহজেই। যে অলিগার্ক বা গোষ্ঠী এই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে তাদের তুষ্ট রাখা যায় এই প্রকল্প দিয়েই।

এতদিন পর্যন্ত সরকারের একটাই স্লোগান ছিল আর তা হলো উন্নয়ন। সেই উন্নয়নের বয়ানে জায়গা হয়নি গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বা সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের কোনো কথা। এই উন্নয়ন মানেই ছিল প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প, রিজার্ভ আর বিদ্যুৎ। কিন্তু জানি না হঠাৎ কি হলে? দেখা যাচ্ছে তীব্র আর্থিক সংকটে ডুবছে দেশ। শোনা যাচ্ছে রিজার্ভ সংকট, মূল্যস্ফীতি, টাকার বিপরীতে ডলারের অবিশ্বাস্য দাম বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটের কথা।

সংকট এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী বলতে বাধ্য হচ্ছেন ‘আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ৬ মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কিনা- জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।’

গ্যাস, বিদ্যুৎ অর্থাৎ জ্বালানি খাতের অবস্থা কতটা নাজুক সেটা শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কথা থেকেই স্পষ্ট। শিল্প খাতে জ্বালানি সংকটের প্রভাব হ্রাস নিয়ে এক আলোচনা সভায় দেশের বিভিন্ন খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে দিনের প্রায়অর্ধেক সময় তাদেরকার খানাবন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কমছে। রপ্তানির ক্রয়াদেশও কমে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান নিয়েই।

ব্যবসায়ী নেতারা এখন চান প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ। আমদানি রপ্তানির নামে ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার, অন্যদিকে রপ্তানি আয় আর রেমিট্যান্সের নিম্নগতি সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ পুরো বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের তথ্য গোপনের প্রবনতা। সরকার রিজার্ভের যে তথ্য দিচ্ছে সেটি কতটা সঠিক তা নিয়েও আছে নানান প্রশ্ন।

কারণ বিদ্যুৎ গ্যাসের এই ভয়াবহ সংকটের সময়ও সরকার জ্বালানি তেল ডিজেল বা এলএনজি আমদানি করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা শিল্প উদ্যোক্তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে রিজার্ভের এই অবস্থায় স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি আমদানি সম্ভব নয়। যে মন্ত্রী ভুলেও কখনো কথা বলেন না সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বলে ফেললেন বিদ্যুতের সংকট সহসা কাটছে না। কারণ জ্বালানি আমদানির মতো পর্যাপ্ত রিজার্ভ নেই। এই সব আলামত দেখে তাই প্রশ্ন জাগে আমাদের রিজার্ভ আসলে কতো? সূত্র: মানব জমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *