তীব্র ডলার সংকটে পণ্য আমদানিতে লাগাম

তীব্র ডলার সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে গৃহীত বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে আমদানিতে বড় লাগাম পড়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকারি সিদ্ধান্তের পর গত আট মাসে নতুন এলসি খোলা কমেছে ৫৮ শতাংশ বা অর্ধেকেরও বেশি। ফলে গত পাঁচ মাস আগে থেকে এ নিয়ন্ত্রণের সুফল মেলা শুরু। ওই পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ৩৩ শতাংশ। নতুন এলসি খোলা অর্ধেকেরও বেশি কমায় ইতোমধ্যে বাজারে আমদানি পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

আমদানি পণ্য ও আমদানি করা কাঁচামালনির্ভর দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম পাগলা ঘোড়ার গতিতে বেড়ে চলেছে। আগামীতে এসব পণ্যের সংকট আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে শিল্প খাতসহ দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।

এতে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায় লাগামহীন গতিতে। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সব মিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যায়। এর বিপরীতে বেড়ে যায় ব্যয়। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ পরিস্থিতিতে ডলার সাশ্রয় করতে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে আমদানি ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে এলসি খোলা কমতে থাকে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয়ও কমতে থাকে।

তবে করোনার সময়ে স্থগিত আমদানি পণ্যের ব্যয় মেটানোর কারণে মাঝে মধ্যে এ ব্যয় বেড়েছে। এলসি খোলার তিন মাস পর থেকে সাধারণত আমদানি পণ্য দেশে আসতে থাকে। এতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়ার তিন মাস পর জুলাই থেকে আমদানি ব্যয়ও কমতে থাকে। গত মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই আট মাসে নতুন এলসি খোলা কমেছে ৫৪৯ কোটি ডলার বা ৫৮ শতাংশ। গত জুলাই থেকে নভেম্বর এই পাঁচ মাসে আমদানি কমেছে ২৭৭ কোটি ডলার বা ৩৩ শতাংশ।

গত মার্চে এলসি খোলা হয়েছিল ৯৫১ কোটি ১৭ লাখ ডলারের। বাংলাদেশে এটিই ছিল সর্বোচ্চ এলসি খোলা। মার্চ থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ শুরু করায় এপ্রিলে এসে এলসি খোলা কমে গিয়ে ৮৪১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। মে মাসে আরও কমে ৬৯৬ কোটি ডলার হয়। জুন ও জুলাইয়ে এলসি খোলা আবার বেড়ে যায়। জুনে ৭০২ কোটি ডলার ও জুলাইয়ে ৭৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। এ সময়ে পণ্য আমদানিতেও আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।

একই সঙ্গে ডলার সংকট আরও প্রকট হলে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে আগস্টে এলসি খোলা কমে ৭৬৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারে নেমে যায়। সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে ৬০৫ কোটি ডলারে নামে। অক্টোবরে রেকর্ড পরিমাণে কমে ৪৭৪ কোটি ডলার হয়। নভেম্বরের সাময়িক হিসাবে এলসি খোলা আরও কমে ৪০২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

গত বছরের মার্চে আমদানি হয়েছিল ৭৯৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। এপ্রিলে তা কমে ৭২৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। মে মাসে সামান্য বেড়ে হয় ৭৪১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। জুনে তা বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ ৮৩৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। এটিই সবচেয়ে বেশি আমদানি ব্যয়। এরপর থেকে মার্চে নেওয়া আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুফল আসতে থাকে। কমতে থাকে আমদানি ব্যয়। জুলাইয়ে তা কমে ৭৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার হয়। আগস্টে তা আরও কমে ৬২৮ কোটি ৬৭ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। স্থগিত করা আমদানি দায় পরিশোধের কারণে গত সেপ্টেম্বরে এসে ব্যয় আবার বেড়ে ৭১০ কোটি ৩ লাখ ডলারে ওঠে।

এরপর থেকে আবার কমতে থাকে। অক্টোবরে আমদানি ব্যয় কমে দাঁড়ায় ৬৪১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে। নভেম্বরের সাময়িক হিসাবে আমদানি ব্যয় আরও কমে ৫৬০ কোটি ১৪ লাখ ডলার হয়। চলতি ডিসেম্বরে আমদানি ব্যয় আরও কমে যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আভাস দিয়েছে। তবে রোজানির্ভর ভোগ্যপণ্য আমদানির কারণে এলসি খোলার হার বাড়তে পারে। তাদের মতে, ডিসেম্বরে এলসি খোলা হতে পারে ৫০৮ কোটি ডলারের বেশি। কেননা রোজানির্ভর পণ্যের আমদানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ডলারের জোগান বাড়ানো হবে। গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে এলসি খোলা হতে পারে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৩৩৭১ কোটি ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে ২৮২৮ কোটি ডলারের। আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা কমেছে ৫৪৩ কোটি ডলার বা ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৩১১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩৪৪৬ কোটি ৪৭ ডলার। ওই সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ৫৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে বেড়েছে ১১ শতাংশ। মূলত করোনার কারণে স্থগিত করা আমদানির বিল পরিশোধ করায় আমদানি ব্যয় কিছুটা বাড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *