অর্থাভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে উপবৃত্তি দিয়ে আসছে সরকার। ভোগান্তি এড়াতে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হয় অভিভাবকের মোবাইল ওয়ালেটে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর ১৬ মাসের উপবৃত্তির অর্থ আটকে আছে। এতে বিপাকে পড়েছেন এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবক। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রদানে ভুল-ভ্রান্তির জন্য এ অর্থ দেওয়া যাচ্ছে না। তথ্য সংগ্রহ করে শিগগির সব টাকা পরিশোধ করা হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের টাকা প্রদানে নতুন করে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ২৫ অক্টোবর বাদ পড়া এসব শিক্ষার্থীর হাতে উপবৃত্তির অর্থ পাঠানোর কথা রয়েছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রাথমিকের উপবৃত্তি কার্যক্রম রাজস্ব খাতে নেওয়া হলেও জনবল নিয়োগ না হওয়ায় এ কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) থেকে জানা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রকল্পের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হতো। সবশেষ প্রকল্প চলাকালীন অর্থ বণ্টন করা হতো মোবাইল ব্যাংকিং ‘নগদ’র মাধ্যমে। চলতি বছরের জুলাই থেকে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নগদ যে সফটওয়্যারে কাজ করতো তা বাতিল করা হয়। এটি রাজস্ব খাতে নেওয়ায় সরকারি ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ সফটওয়্যারে নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়।
ছয় মাস ধরে মাঠ পর্যায়ের ডাটা সংগ্রহের কাজ চলে। সারাদেশ থেকে এক কোটি শিক্ষার্থীর ডাটা সংগ্রহ করা হলেও ১৩ লাখ শিশুর ডাটা নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। জানা যায়, ২০২১ সালের জুলাই থেকে প্রায় ১১ মাস শিক্ষার্থীদের অর্থ আটকে যায়। নতুন ডাটা সংগ্রহ করে প্রায় ৮৫ হাজার শিশুকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত উপবৃত্তির বকেয়া পরিশোধ করা হয়।
এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল, তাতে নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি চিহ্নিত হওয়ায় তাদের অর্থ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এজন্য শিক্ষকদের ফের তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অভিভাবক যে মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দিয়েছেন, সেটির মাধ্যমে উপবৃত্তি দেওয়া হবে।
উপবৃত্তি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৯ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের বকেয়া ছয় মাসের অর্থ পেয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ শিক্ষার্থী। বাকি ১৪ লাখের তথ্যে নানা ধরনের ভুল চিহ্নিত হওয়ায় নতুন করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হলে গত বছরের বকেয়া ছয় মাসের অর্থ চলতি মাসে (২৫ অক্টোবর) পরিশোধ করা হবে।
তারা জানান, উপবৃত্তির জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনলাইনে শিক্ষার্থীর তথ্য যুক্ত করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠান। তিনি সেটি অনুমোদন করে পাঠান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। জেলা থেকে সেটি অধিদপ্তরে পাঠালে প্রোগ্রামারের কাছে পাঠানো হয়। সেখান থেকে যুক্ত করা হয় ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ সফটওয়্যারে। বিদ্যালয় থেকে তথ্য পাঠানোর পর নানা ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ে। যেমন কোনো অভিভাবক জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিতে পারেননি, মোবাইল নম্বর ভুল, অর্থ উত্তোলন মাধ্যম ভুল নির্বাচন প্রভৃতি ভুল ধরা পড়ে। এ কারণে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির অর্থ আটকে যায়।
উপবৃত্তির অর্থ প্রদানে নতুন করে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে ২০০৮ সালে ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’ গ্রহণ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ ২০১৫ সালের ৩০ জুন শেষ হয়।
এরপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ পর্যায়ে প্রথমে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। পরে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় আরও ১০ লাখ শিক্ষার্থী। প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলে আরও দুই বছর সময় বাড়ানো হয়। সবশেষ সংশোধনীতে আরও দেড় বছর বাড়িয়ে গত বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়।
তারা জানান, উপবৃত্তি প্রকল্প রাজস্ব খাতে নেওয়ার পর ৩৪টি নতুন পদ তৈরি করে সেটি জনপ্রশাসনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে ২১ পদের অনুমোদন দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদনের পর সেসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। বর্তমানে একজন উপ-পরিচালক ও আটজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দিয়ে এ প্রকল্প চালানো হচ্ছে বলে কাজের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ে উপবৃত্তির অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) মো. রুহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করা হলে সেখানে নানা ধরনের ভুল থেকে যায়। সে কারণে কিছু শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। নতুন করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে গত বছরের বকেয়া পরিশোধ করা হবে। পরবর্তীসময়ে উপবৃত্তির টাকা পরিশোধ করা হবে ছয় মাস পরপর। নতুন করে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে সেটি সচিব কমিটিতে রয়েছে। দ্রুতসময়ে এ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আগে শিক্ষার্থীর পরিবারকে মাসে ১০০ টাকা দেওয়া হলেও এখন ১৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। একইভাবে দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ২০০ টাকার বদলে ৩০০ টাকা, তিন শিক্ষার্থীর পরিবারকে ২৫০ টাকার জায়গায় ৪০০ টাকা এবং চার শিক্ষার্থীর পরিবারকে মাসে ৩০০ টাকার জায়গায় ৫০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, উপায়, ট্যাপ, মাই ক্যাশ, টেলিক্যাশ, ওকে ওয়ালেট ও ইসলামিক ওয়ালেট এবং ডাক বিভাগের নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তির অর্থ অভিভাবকদের মোবাইলে পাঠানো হয়।