মাসের পর মাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে সারাদেশের মতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন নারায়ণগঞ্জের শিল্প মালিকরা। তারা না পারছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে আবার না পারছেন কারখানা চালু রাখতে। শিল্প মালিকরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ থাকবে না। শিল্প কারখানা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে মাঝারি ধরনের কারখানাগুলোকে প্রতিমাসে ১২ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা ডিজেলের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। ডিজেল আর বিদ্যুৎ মিলে এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ থেকে ৩২ লাখ টাকা। কিন্তু আগে বিদ্যুৎ বিল আসতো ২০ লাখ থেকে ২২ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিমাসে ১০ লাখ থেকে ১২ টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে। পাশাপাশি জেনারেটর সার্ভিসসহ আর অন্য খরচ তো আছেই। আবার যখন জেনারেটর নষ্ট হয়ে যায় তখন পুরো উৎপাদনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে ফ্যাক্টরিগুলোও খরচ বেড়ে গেলেও জেনারেটর দিয়ে চালানো যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। যেসব কারখানা বয়লার ব্যবহার করে তাদের গ্যাস ছাড়া চলে না। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। অনেক সময় যখন গ্যাস থাকে তখন একটি বয়লার চালু করা হলে সেটা হিট হতে দেড় থেকে দুইঘণ্টা সময় লাগে। দেড় থেকে দুইঘণ্টা লাগিয়ে যখন বয়লার হিট করা হয় তখন আবার গ্যাসের চাপ কমে গেলে বয়লার বন্ধ হয়ে যায়। এসময় বয়লারে থাকা মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে কারখানাগুলোকে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা ফ্যাক্টরি গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের সহজে বের হয়ে আসারও সুযোগ নেই। কারণ বেশিরভাগ কারখানা মালিক ব্যাংক ঋণে জর্জরিত। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি (অর্থ) মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে আমাদের কারাখানাগুলোকে প্রতিমাসে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে জেনারেটর চালাতে গিয়ে আনুষঙ্গিক আরও অনেক খরচ রয়েছে। আর গ্যাসের সংকট শুধু নারায়ণগঞ্জ নয় সারা দেশব্যাপী চলছে। বিশেষ করে আমাদের নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের চাপ অনেক কম। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমেছে।
তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে সব ফ্যাক্টরিতে চালান ঘাটতি হচ্ছে। তাদের লাভ তো দূরের কথা কিছু কিছু ফ্যাক্টরি আছে যারা ব্যাংক লোনের কিস্তি দিতে পারছে না। যার কারণে ব্যাংকগুলোও অনেক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিচ্ছে। সবমিলিয়ে আমাদের ব্যাবসাক্ষেত্রে খুবই নাজুক অবস্থা চলছে। আর এটার প্রভাব সারাদেশের ওপরই পরবে। মোর্শেদ সারোয়ার বলেন, ২০২৩ সাল আন্তর্জাতিকভাবে যেমন খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে তেমনিভাবে আমাদের দেশের পরিস্থিতিও খারাপ অবস্থার দিকে যাবে। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, প্রোডাকশন নেই, এক্সপোর্ট নেই, ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী সবমিলিয়ে ২০২৩ সালটা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাবে।
সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আমাদের ক্ষেত্রে সিএনজি পাম্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ সিএনজির বিকল্প হিসেবে ডিজেল রয়েছে। ডিজেল ইমপোর্ট করা যাচ্ছে যা গ্যাসের ক্ষেত্রে করা যাচ্ছে না। আর গ্যাস শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বাসাবাড়ি থেকে চোরাই লাইন নিয়ে গ্রামের পর গ্রামে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে আবার সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাসাবাড়ির জন্য হয় মিটারের ব্যবস্থা করা হোক অথবা বন্ধ করে দেওয়া হোক। গ্যাসের কারণে ফ্যাক্টরি যদি না চালানো যায় তাহলে দেশের জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ এই ফ্যাক্টরির সঙ্গে সারাদেশের মানুষ জড়িত।
বিকেএমইএর আরেক সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, এমনিতেই ইউরোপের অর্থনীতির কারণে আমাদের ব্যবসার অবস্থা একটু খারাপ। সেইসঙ্গে গ্যাসের সমস্যার কারণে প্রোডাক্ট সময়মতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে অতিরিক্ত প্রেশারের মধ্যে দিয়েই দিন যাচ্ছে আমাদের। আমাদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গ্যাসের সমস্যার কারণে ৪০ থেকে ৫০ পার্সেন্ট ফ্যাক্টরির উৎপাদন বন্ধ করে রয়েছে। তাদের উভয় সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার হচ্ছে। আগামী দুই মাস টিকে থাকতে পারলে হয়তো পরিস্থিতি উন্নত হতে পারে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান চরম সংকট চলছে এবং এই সংকটের কারণে বহু ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে। অনেকের পক্ষে সামনের মাসগুলোতে শ্রমিকের বেতন দেওয়াও কঠিন হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে অনেককেই ফ্যাক্টরি গুটিয়ে ফেলতে হবে। ব্যাংকিং সমস্যা, পেমেন্ট আসছে না, অর্ডার নেই, বেতন দিতে পারছে না সবমিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছে আমাদের। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে কতদিন টিকে থাকা যাবে এটা নিয়ে আমাদের শঙ্কা।
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারকে আমরা বলেছি, রপ্তানি অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করেন। আমরা তিনগুণ ফেরত দিতে পারবো। সেটা না করে উল্টো যদি গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের রপ্তানি ব্যাহত হবে। সর্বোপরি এই সমস্যা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। রপ্তানি করতে পারলে সবকিছু ঠিকমতো চলবে, আমাদের ৪০ লাখ শ্রমিকের বেতন-ভাতা চলবে, রিজার্ভও থাকবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নারায়ণগঞ্জের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, সারাদেশেই যেহেতু গ্যাসের সংকট সে হিসেবে ব্যবসায়ীদের অবস্থা ভালো না। তারা আগের তুলনায় ভালো নেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে তাদের অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। নতুন করে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করতে পারলে হয়তো এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হওয়া সহজ হবে। সেইসঙ্গে দেশীয় গ্যাসের সক্ষমতা বাড়াতে পারলেও সংকট দূর করা যাবে।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মামুনার রশীদ বলেন, বর্তমানে সারাদেশেই গ্যাসের চাপটা কম। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এজন্য সবজায়গাতেই সমস্যা হচ্ছে। এলএনজি ইমপোর্ট না করা পর্যন্ত এই সমস্যা থেকে যেতে পারে। কারণ আমাদের কিছু গ্যাস বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। ওইটা কেনা যাচ্ছে না। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ফতুল্লা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান বলেন, আসলে এটা তো সরকারের ব্যাপার। আমরা সিডিউল মেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। তবে আশা করি, দুই-একদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কোনো সমস্যা থাকবে না।