আর্জেন্টিনা-বাংলাদেশ বন্ধুত্বে বাণিজ্যের পালে নতুন হাওয়া

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন বছর পরেই এ দেশে দূতাবাস খুলেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু সামরিক জান্তার শাসনামলে ১৯৭৮ সালে দূতাবাসের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয় তারা। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ ৪৫ বছর। এত লম্বা সময় ঢাকায় দূতাবাস না থাকলেও আর্জেন্টাইনদের প্রতি বাংলাদেশিদের সমর্থন বিন্দুমাত্র কমেনি। সাম্প্রতিক ফুটবল বিশ্বকাপে তার নজির দেখেছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা-ভক্তদের উন্মাদনা অবাক করেছে বিশ্ববাসীকে। বিষয়টি নজর এড়ায়নি লিওনেল মেসিদেরও।

সেই ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফের দূতাবাস চালু করেছে আর্জেন্টিনা। তার ফলে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যতেও। ঢাকায় দূতাবাস না থাকলেও আর্জেন্টিনার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য থেমে ছিল না। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের আর্থিক পরিমাণ ৯০ কোটি ডলারেরও কম। তবে দূতাবাস চালু হওয়ার পরে আগামী দুই বছরের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

তিনি জানিয়েছেন, দুই দেশের বর্তমান বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আর্জেন্টিনায় ৯৫ লাখ ২০ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে আমদানি করেছে ৭৯ কোটি ১৫ লাখ ডলারের পণ্য। আর্জেন্টিনা থেকে প্রধানত সয়াবিন তেল ও চিনি আমদানি করে বাংলাদেশ। তবে লাতিন আমেরিকার দেশটি থেকে সূর্যমুখী তেল, গম, অ্যানিমেল ভেজিটেবল ফ্যাটস অ্যান্ড অয়েল, তৈলবীজ, ফলমূল, দুগ্ধজাত পণ্য, প্রাকৃতিক মধুও আমদানি করা যেতে পারে।

বিপরীতে, বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনায় রপ্তানি হয় খুব সামান্যই। সাম্প্রতিক সুসম্পর্কের জেরে আর্জেন্টিনায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর বড় সুযোগ সামনে এসেছে বাংলাদেশের। এ বিষয়ে আগ্রহও দেখিয়েছেন আর্জেন্টিনার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। পাশাপাশি, বাংলাদেশ থেকে উচ্চমানের ফার্মাসিউটিক্যালস, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করতে পারে আর্জেন্টিনা।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ওইসি ওয়ার্ল্ডের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি (৬৫ শতাংশ) সয়াবিন রপ্তানি করে আর্জেন্টিনা। এরপর রয়েছে গম ও ভুট্টা। এছাড়া হিমায়িত মাংস, সোনা, অ্যালুমিনিয়াম, ডেলিভারি ট্রাক, মোটর যন্ত্রাংশের মতো পণ্যও রপ্তানি করে তারা। আর্জেন্টিনা সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে প্রতিবেশী দেশ ব্রাজিলে। এরপর রয়েছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, থাইল্যান্ড প্রভৃতি। অর্থাৎ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে আর্জেন্টিনার রপ্তানি বাণিজ্য বেশ শক্তিশালী।

আর্জেন্টিনায় রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ
বর্তমানে আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি (২১ দশমিক ৭ শতাংশ) রপ্তানি হয় নিট সোয়েটার। এরপর রয়েছে নিট টি-শার্ট, নন-নিট মেনস স্যুট, টেক্সটাইল ফুটওয়্যার প্রভৃতি।বাণিজ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ট্রেডিং ইকোনমিকসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ আর্জেন্টিনায় তৈরি পোশাকের পাশাপাশি আরও কিছু পণ্য রপ্তানি করে। তবে এর পরিমাণ কম। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বই, ছবি, হেডগিয়ার, টেক্সটাইল ফাইবার, ফেব্রিক, সিরামিক পণ্য, প্লাস্টিক, পশুর নাড়িভুড়ি, ভ্রমণ পণ্য, আসবাব, কার্পেট, লোহা, যন্ত্রাংশ, রাবার প্রভৃতি।

ওয়েবসাইটটির তথ্যমতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪৮ হাজার ডলারের প্লাস্টিক পণ্য আমদানি করেছিল আর্জেন্টিনা। এগুলোর মধ্যে নানা ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার উল্লেখযোগ্য। ওই বছর তারা বাংলাদেশ থেকে একই ধরনের সিরামিক পণ্য আমদানি করেছিল প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ডলারের। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আর্জেন্টিনায় এসব পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এর সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। এছাড়া, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগের মাধ্যমেও উপকৃত হবে আর্জেন্টিনা।

বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের কারখানা স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে আর্জেন্টিনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছেন, আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভোজ্যতেলের কারখানা স্থাপন করলে তুলনামূলক কম দামে তেল সরবরাহ করতে পারবে। একই সঙ্গে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও রপ্তানি করা সম্ভব। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চুক্তিতে সই করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, এই চুক্তির ভিত্তিতে কিছু দিন পরে টিসিবির সঙ্গে আর্জেন্টিনার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আরেকটি সমঝোতা স্মাবরক সই হবে। এরপর আর্জেন্টিনা থেকে সরাসরি আমদানি করতে পারবে টিসিবি। বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখন থেকে বাংলাদেশের সরকারি কর্মীরা ভিসা ছাড়াই আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। ভবিষ্যতে সাধারণ নাগরিকরাও অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা পেতে পারেন। এতে দুই দেশের বাণিজ্য ও অন্যান্য সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে আশাপ্রকাশ করেছে তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *