আবেদ খান : এক আদর্শের নাম

মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার জগতে এক অনন্য নাম আবেদ খান। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রতিবাদী, নীতি-নৈতিকতায় আপোসহীন এবং মানবতার কাছে নতজানু। এই চরম সুবিধাবাদী সমাজে মানুষ ছুটছে সুবিধার দিকে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে, হয়ে যাচ্ছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। কিন্তু এই চরম সুবিধাবাদ আবেদ খানকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের পরিবার মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। আওয়ামী লীগ দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায়। তিনি যদি সুবিধাবাদী হতেন, তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই লাভ করতে পারতেন। তিনি নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারেননি বলে তা করতে পারেননি। বরং টাকার অভাবে তিনি তাঁর প্রত্রিকা ‘দৈনিক জাগরণ’ চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে আবেদ খান পথিকৃত।

তিনি ১৯৬২ সালে ১৭ বছর বয়সে সাংবাদিকতা জগতে হাতেখড়ি নেন এবং দৈনিক জেহাদের সহ-সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে হন দৈনিক সংবাদের সহ-সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে সহ-সম্পাদক হিসেবে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগদান করেন এবং ১৯৯৫ সন পর্যন্ত প্রধান প্রতিবেদক, কলামিস্ট হিসেবে লেখালেখি করেন, শিফট ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক ভোরের কাগজ (২০০৩-২০০৫), দৈনিক যুগান্তর (২০০৫-২০০৬), দৈনিক সমকাল (২০০৬-২০১০) এবং দৈনিক কালের কণ্ঠ (২০১০-২০১১)। তিনি ছিলেন কালের কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং কালের কণ্ঠ নামটি তাঁর নিজের দেওয়া। তিনি ২০১২-২০১৩ সনে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সন থেকে তিনি দৈনিক জাগরণের সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি ২০২০-২০২১ সনে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এত সব দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো আদর্শচ্যুত হননি।

পত্র পত্রিকার সম্পাদকের পদ পাওয়া একজন সাংবাদিকের বড় প্রাপ্তি। আবেদ খান নীতি বিসর্জন দিয়ে পদকে আকড়ে ধরে থাকেননি। পুঁজিবাদের চরম উৎকর্ষতার যুগে প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার মালিক হচ্ছেন শিল্পপতিরা। মিডিয়া হচ্ছে তাদের সেফগার্ড। মালিকরা তাদের অনেক অকাম-কুকাম জায়েজ করেন তাদের মিডিয়া দ্বারা। আবেদ খান তাঁর বিবেক বিসর্জন দিয়ে মালিকদের অপকর্ম জায়েজ করতে অক্ষম ছিলেন। এ জন্য তিনি সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করতেন না। যেখানে নীতি নৈতিকতা জাদুঘরে চলে গেছে, ভালো মানুষের দুর্ভিক্ষ চলছে, আবেদ খান নিশ্চয়ই সেখানে ব্যতিক্রম।

আবেদ খান একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালিরা বুঝে গিয়েছিল, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই এলাকাভিত্তিক স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব চলতে থাকে। ১ মার্চ, ১৯৭১ পুরান ঢাকার নারিন্দা-ওয়ারি এলাকার স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক হন আবেদ খান, যুগ্ম আহবায়ক হন মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাক হানাদার বাহিনী তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাংক নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইত্তেফাক অফিস জ্বালিয়ে দেয়। তাদের সাঁড়াশি আক্রমণে টিকতে না পেরে আবেদ খান মাচের্র শেষের দিকে ঢাকা ছাড়েন। বহু কষ্টে সীমান্ত পারি দিয়ে কলকাতা পৌঁছেন মে মাসে। ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে তার সঠিক প্রচার পাচ্ছিল না। কলকাতার আকাশবাণীতে আবেদ খানের সাক্ষাৎকার প্রচারের পর তা ব্যাপক প্রচার পায় এবং বিশ্বের সহানভূতি লাভ করতে থাকে। তারপর তিনি আকাশবাণীতে ‘জবাব দাও’ নামে এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান শুরু করেন; যার প্রত্যুত্তরে তখন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে রেডিও পাকিস্তান ‘জবাব নিন’ অনুষ্ঠান শুরু করে।

আবেদ খান একজন কলম সৈনিক। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও তাঁর যুদ্ধ শেষ হয়নি। তাঁর যুদ্ধ এখনো চলমান। যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তরে ধারণ করেন তাঁর যুদ্ধ শেষ হতে পারে না। সে যুদ্ধ তিনি এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন লেখনীর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দুটি। একটি স্বাধীনতা, অন্যটি মুক্তি। মুক্তির অর্থ ব্যাপক। মুক্তি মানে অজ্ঞতা অন্ধকার থেকে মুক্তি, অসত্য অসুন্দর ও অযৌক্তিকতা থেকে মুক্তি, অন্যায় অবিচার থেকে মুক্তি, অভাব অনটন থেকে মুক্তি, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি, গোড়ামি থেকে মুক্তি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তি, ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি, বন্ধন থেকে মুক্তি, বৈষম্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তি। মুক্তির যুদ্ধ নিরন্তর। এই জন্য বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার আগে মুক্তির কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম ম্বাধীনতার সংগ্রাম।” স্বাধীনতা অর্জন কঠিন, কিন্তু মুক্তি পাওয়া আরো কঠিন। স্বাধীনতার লক্ষ্য মুক্তি। মুক্তি ব্যতীত স্বাধীনতা অর্থহীন। স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষ হলেও মুক্তির যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়। জীবন যতদিন আছে, মুক্তির সংগ্রামও ততদিন থাকবে। সেই মুক্তির সংগ্রামের একজন নিরন্তর সৈনিক আবেদ খান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে সে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তিনি তাঁর কলম চালনা করতে পিছপা হননি। কলম চালিয়েছেন জিয়া এরশাদের স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠিীর বিরুদ্ধে। সোচ্চার থেকেছেন ৭১- এর ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। সে জন্য তাঁকে কম হয়রানির শিকার হতে হয়নি। ১৯৮৭ সনে সামরিক শাসক এরশাদ তাঁকে বেতার টেলিভিশনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে জঙ্গিরা এক যোগ গ্রেনেড হামলা করে। তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলা না করে মামলা করে আবেদ খান, মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবির প্রমুখের নামে। কারণ তাঁরা মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন। মৌলবাদীদের কাছ থেকে তিনি কম হুমকি পাননি।

আবেদ খান একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। যখনই দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, তখনই তিনি সেখানে ছুটে গিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন, দখল চরম আকার ধারণ করে। তখনো আবেদ খানরা ধর্ষিতা, নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জোট সরকারের সময় ঝিনাইদহের স্থানীয় সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলে তিনি সেখানে ছুটে যান এবং তার প্রতিবাদে অনশন করেন। তাতে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গিদের ওপরও হামলা হয়। তাতে তিনি থেমে যাননি। তাঁর বয়স হয়েছে, শরীরও তত ভালো যাচ্ছে না। তারপরেও কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে তিনি দাঁড়ান। তাঁর নীতি-আদর্শ, মানবতাবোধ অতি উচ্চ মার্গের। তাঁর এথিকস, মানবতাবোধ যদি আমরা অনুকরণ করতে পারতাম, তাহলে আমাদের সমাজ হতো একটি মানবিক সমাজ।

আবেদ খান একাধারে একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, উপস্থাপক, সঞ্চালক, আবৃত্তিকার, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী। তিনি অনেক প্রবন্ধ, গল্প, শিশু সাহিত্য রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন। তিনি বিশটিরও বেশি বই লিখেছেন। তাদের মধ্যে ১. অভাজনের নিবেদন, ২. গৌড়ানন্দ কবি ভনে শুনে পুণ্যবান, ৩. কালের কণ্ঠ, ৪. প্রসঙ্গ রাজনীতি, ৫. হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে (গল্প সংকলন), ৬. আনলো বয়ে কোন বারতা, ৭. বলেই যাবো মনের কথা, ৮. গৌড়ানন্দসমগ্র।, ৯. অনেক কথা বলার আছে, ১০. দেশ কি জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হবে, ১১. ও রাজকন্যে তোমার জন্য, ১২. স্বপ্ন এলো সোনার দেশে, ১৩. আমাদের টুকুনবাবু, ১৪. ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড ) অন্যতম। বাংলাদেশের কত উত্তম অধমকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে ফেব্রুয়ারি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়; অথচ আবেদ খানের মতো ব্যক্তিকে তা প্রদান করা হয় না। এটাই পরিতাপের বিষয়। বিষয়টি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের মতো। বিশ্বে অহিংস রাজনীতির ধারক বাহক, প্রবর্তক হলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি ছিলেন হিংসা, যুদ্ধ, মারামারি, সহিংসতার বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন বিশ্বের অহিংস ও শান্তিবাদী নেতা। তাঁর ভাগ্যে নোবেল প্রাইজ জুটেনি। জুটেছে যুদ্ধবাজ চার্চিল ও হেনরি কিসিঞ্জারের ভাগ্যে। এটাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। যদিও জাতিসংঘ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস ঘোষণা করে তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়েছে। আশা করি, বাংলাদেশ সরকার ও বাংলা একাডেমির বোধোদয় হবে; আবেদ খানের মতো গুণীজনকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিবে। আজ ১৬ এপ্রিল এই মহান মানুষটির ৭৮তম জন্ম দিনে নিদেবন করছি লাল সালাম। জয় গুরুদেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *