নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে মানি চেঞ্জারগুলো। দেশে ডলার সংকটের পর থেকে একের পর এক উঠে আসছে তাদের অবৈধ কার্যক্রম। ডলারের মূল্য বাড়াতে কারসাজি, বিদেশে অর্থ পাচার, নগদ অর্থ লেনদেনের হিসাবে কারচুপি, অনুমোদন ছাড়া একাধিক শাখা পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ আসছে তাদের বিরুদ্ধে। কেবল অবৈধ প্রতিষ্ঠানই নয়, বৈধ অনেক মানি চেঞ্জারও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এসব কার্যক্রমে জড়িয়েছে।
এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শতাধিক মানি চেঞ্জারের অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সপ্তাহ গেলেই এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে সিআইডি এই নজরদারি করছে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত মানি চেঞ্জারগুলোর মধ্যে বর্তমানে ২৩৫টি প্রতিষ্ঠানের বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে বৈধ-অবৈধ, বেআইনি শাখা মিলে মানি চেঞ্জারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০০টির মতো। এ হিসাবে অবৈধ মানি চেঞ্জার বা শাখা রয়েছে ৯৬৫টি। বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২০২টি প্রতিষ্ঠান ঢাকার মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।
এই সবকটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়েই তদারক সংস্থাগুলো খোঁজখবর রাখছে। প্রাথমিকভাবে অনিয়মের খবর পেলেই শুরু হচ্ছে তদন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বৈধগুলোর মধ্যে নানা অভিযোগে নয়টির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। একটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। এদিকে অর্থ পাচারে জড়িত সন্দেহে ২৮টি মানি চেঞ্জারের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বিএফআইইউ। ২০টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে।
আর লাইসেন্স ছাড়াই বিদেশি মুদ্রা লেনদেন করায় ১১টি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৪৫টিকে শোকজ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে যে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিআইডির তদন্ত চলছে, তার প্রায় ৮০ ভাগই ঢাকার মতিঝিল, গুলশান, ধানমন্ডি, উত্তরা ও পল্টন এলাকার। এই এলাকাগুলোয়ই মানি চেঞ্জারগুলোর সবচেয়ে বেশি অবৈধ কারবার হয়। এছাড়া বিএফআইইউ-এর তদন্তে ১৩টি মানি চেঞ্জারের বিরুদ্ধে হুন্ডির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের বিষয়ে আরও ব্যাপক তদন্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, অবৈধ মানি চেঞ্জারগুলোর পাশাপাশি বৈধগুলোও দীর্ঘদিন ধরে অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়ম করছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। ডলারের কারসাজি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে শতাধিক মানি চেঞ্জারের অনিয়ম তদন্ত করছে সিআইডি। নজরদারি টের পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে।
অনেকে আবার কৌশল পরিবর্তন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ না করে কৌশল পরিবর্তন করলে কোনো লাভ হবে না। প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর ও পরিষ্কার। সিআইডি জানায়, তারা মানি চেঞ্জারগুলোর বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কয়েক ধরনের অপরাধ পেয়েছে। এর মধ্যে বৈধ লাইসেন্স নিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
একটি লাইসেন্সের বিপরীতে এক ডজন মানি চেঞ্জার পরিচালনারও তথ্য পেয়েছে তারা। লিমিটেড কোম্পানির নামে নেওয়া লাইসেন্স দিয়ে প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডার একই নামে আলাদা প্রতিষ্ঠান খুলেও ব্যবসা পরিচালনা করছে। অথচ একটি লাইসেন্সের বিপরীতে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। আবার অবৈধ মানি চেঞ্জারগুলো বিদেশগামী বিভিন্ন যাত্রীদের পাসপোর্টে ভুয়া সিলের মাধ্যমে ডলার এনডোর্সমেন্ট করছে।
এতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অবৈধ চেঞ্জারগুলোয় বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা মূল্যের ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করছেন। সেগুলোর বড় অংশই খোলাবাজার থেকে আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার দৈনিক যে পরিমাণ লেনদেন করছে, তার সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করছে না।
অর্থাৎ রেজিস্টারে প্রকৃত লেনদেনের কম রেকর্ড রাখছে। কিছু কিছু মানি চেঞ্জারের অবস্থা এমনও রয়েছে, তারা রেকর্ডে যে পরিমাণ লেনদেন উল্লেখ করেছে, ব্যবসার প্রকৃত চিত্র তেমন হলে তাদের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ এত কম পরিমাণ মুদ্রা লেনদেন হলে প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা অসম্ভব। অথচ বছরের পর বছর তারা দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। কিছু প্রতিষ্ঠান কম দরে ডলার কিনে সেগুলো খোলাবাজারে বেআইনিভাবে বেশি দামে বিক্রি করেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম খুব সহজেই অনুমেয়।
সন্দেহভাজন লেনদেন করা এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও নজরদারি চলছে। এদের অনেকের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।এদিকে এসব মানি চেঞ্জারগুলোর অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও। অর্থনৈতিক অপরাধ নিয়ে কাজ করেন সিআইডির এমন একাধিক কর্মকর্তা এক্ষত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, নব্বইয়ের দশকে ৬৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে মানি চেঞ্জার পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়।
শর্ত পূরণ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সেখান থেকে ২৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে বৈধ রেখে বাকিদের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই পরবর্তী সময়ে আদালতে গিয়ে রিট করেন, যা এখনো চলমান রয়েছে। ফলে বৈধ লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও কেবল রিট চলমান থাকার সুযোগ নিয়ে তারা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করে যাচ্ছে। অভিযান পরিচালনা করলেই তারা রিটের সেসব কাগজপত্র সামনে আনছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
এই সমস্যার বাইরে পুলিশ কর্মকর্তারা আরও বলছেন, অনেক সময় অভিযান পরিচালনা করলে অবৈধ কারবারিরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নামে ভুয়া অভিযোগ আনছেন। ফলে এ সংক্রান্ত অভিযান পরিচালনা করে তাদের অনেককে নানা সময়ে হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। সে কারণে এবার সব তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই অভিযান করতে চান তারা। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে ভুয়া অভিযোগের রাস্তা বন্ধ করারও চিন্তা রয়েছে তাদের।
নিয়ম অনুযায়ী মানি চেঞ্জারগুলো কোনো শাখা খুলতে পারবে না। কিন্তু তারা বেআইনিভাবে ব্যবসা বাড়াতে অনেকে একাধিক শাখা খুলেছে। এসব শাখার মাধ্যমে বেআইনিভাবে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করছে। এদিকে গত ১১ সেপ্টেম্বর অর্থ পাচার রোধে মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বয় সভা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সেখানে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া অবৈধ মানি চেঞ্জারের কার্যক্রম বন্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছেন।
সভা সূত্র জানায়, সেখানে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের অননুমোদিত একাধিক শাখা স্থায়ীভাবে বন্ধে সিআইডিকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। একই সঙ্গে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কেও সিআইডিকে জানাবে তারা। জানতে চাইলে মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি একেএম ইসমাইল হক যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী আমরা প্রতিদিন লেনদেনের বিবরণী অনলাইনে দিই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় আমাদের সব কার্যক্রম চলে। অন্যদিকে অবৈধরা যা খুশি তাই করে।
আর বদনাম হয় আমাদেরও। ১৯৯৭ সালে মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স পাওয়া ৬৩৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে ৪০১টির লাইসেন্স বাতিল হয়েছে তাদের অনেকে এখনো বেআইনিভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এদের অনেকের বাতিল হওয়া একটি লাইসেন্সের বিপরীতে একাধিক ব্যবসাও চলছে। তাদের বিষয়ে তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।
লাইসেন্স স্থগিত করা ৯ প্রতিষ্ঠান হলো দিলকুশার আলফা মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, পুরানা পল্টনের অংকন মানি এক্সচেঞ্জ, দিলকুশার অ্যাসোসিয়েটেড মানি চেঞ্জিং কোং লিমিটেড, ফকিরাপুলের বিসমিল্লাহ মানি চেঞ্জার কোং লিমিটেড, নয়াপল্টনের ফয়েজ মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, নীলফামারীর কে অ্যান্ড কে এক্সচেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল, ধানমন্ডির কেয়া মানি চেঞ্জার, মতিঝিলের সুগন্ধা মানি এক্সচেঞ্জ, দিলকুশার ওয়েলকাম মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড।
এর বাইরে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আল ঈমান মানি এক্সচেঞ্জের। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের ২৩৫টি বৈধ মানি চেঞ্জারের তালিকায় লাল চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব মানি চেঞ্জারের হিসাব তলব করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-নিবেদিতা মানি এক্সচেঞ্জ, সিটি মানিটারি এক্সচেঞ্জ, বকাউল মানি এক্সচেঞ্জ, মনডিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ, নাবিলস মানি চেঞ্জার, হিমালয় ডলার মানি চেঞ্জার, ক্যাপিটাল মানি চেঞ্জার,
মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জ, ডিপেনডেন্ট মানি চেঞ্জার, ঢাকা মানি চেঞ্জার, লর্ডস মানি চেঞ্জার, গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জ, ডিএন মানি চেঞ্জার। তালিকায় আরও রয়েছে-অংকন মানি এক্সচেঞ্জ, বিজয় মানি এক্সচেঞ্জ, বিনিময় মানি এক্সচেঞ্জ, বুড়িগঙ্গা মানি এক্সচেঞ্জ, ফয়েজ মানি এক্সচেঞ্জ, কুমিল্লা মানি এক্সচেঞ্জ, এএসএন মানি চেঞ্জার, বিকেবি মানি এক্সচেঞ্জ, কেয়া মানি চেঞ্জার, আলফা মানি এক্সচেঞ্জ, ক্রিস্টাল মানি এক্সচেঞ্জ, দ্য লিয়াজোঁ মানি এক্সচেঞ্জ, উত্তরা মানি চেঞ্জার, বিজয় মানি এক্সচেঞ্জ ও বিজয় ইন্টারচেঞ্জ।