ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সব শর্ত মানার পক্ষে নন দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, আইএমএফ সংস্কারের যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো দেশের অর্থনীতিবিদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই দিয়ে আসছে। এগুলো বাস্তবায়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সরকার বাস্তবায়ন করছে না। এখন আইএমএফ ঋণ পেতে শর্ত মানার একটা চাপ তৈরি করেছে। ভর্তুকি প্রত্যাহার ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আইএমএফ যেসব শর্ত দিচ্ছে এগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
অর্থনীতিবিদদের আরও অভিমত-বর্তমান সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের ঋণের প্রয়োজন রয়েছে। এখন দরকষাকষি করে যেটুকুর মধ্যে সমঝোতা করা যায় সেদিকেই নজর দিতে হবে। বৈশ্বিক সংকট ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সরকার আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। আইএমএফে বাংলাদেশের কোটা অনুযায়ী ৫৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার সক্ষমতা রাখে। তবে সরকার চেয়েছে কম।
ওই ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করতে আইএমএফের একটি মিশন বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছে। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে তারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানছে। ইতোমধ্যে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিএআরসি), পেট্রোবাংলা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে বৈঠক করেছে।
ওইসব বৈঠকে আইএমএফ দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে বেশ কিছু শর্ত চূড়ান্ত করেছে। যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও একটি প্রতিবেদন তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে আইএমএফের কোন কোন শর্ত মানা সম্ভব এবং কীভাবে সে বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। এখন এগুলো নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে। ঋণ পেতে হলে কোন শর্ত কতদিনে বাস্তবায়ন করবে তার অঙ্গীকার করতে হবে সরকারকে।
আইএমএফ বাংলাদেশে মিশন শেষ করে তারা ওয়াশিংটনে ফিরে যাবেন। এরপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা তাদের প্রধান কার্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করবে। এর আলোকে নির্বাহী বোর্ডের সভা হবে। ওই সভায় ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হবে। এটি চূড়ান্ত হতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে। তবে বাংলাদেশ যে এবার আইএমএফ থেকে ঋণ পাবে সেটি আগেই তারা আভাস দিয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, আইএমএফের সব শর্ত মানা উচিত হবে না। তবে কিছু শর্ত তো নিজস্ব উদ্যোগেই বাস্তবায়ন করা উচিত। শুধু যে আইএমএফ বলছে এ কারণেই নয়। আইএমএফের শর্তে ভর্তুকি একেবারে সব খাতেই তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। কিছু খাতে দিতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ যেসব সেবা পায় সেগুলোতে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। একই খাতে বেশিদিন ভর্তুকি দেওয়া ঠিক হবে না।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশেও বাড়ানো হবে, কমলে দেশেও কমানো হবে। কিন্তু অবকাঠামোগত কারণে এটি সেই সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এটি করা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে বাড়ানো হবে, কমলে কমানো হবে। এটি হলে অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্য থাকবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা কমানোর ফলে কোন খাতে কী প্রভাব পড়বে সে ব্যাপারে একটি নীতিমালা থাকতে হবে। তাহলে এর সুফল সবাই পাবে। কিন্তু বাংলাদেশে তেলের দাম একবার বাড়লে আর কমে না। এটি হওয়া উচিত নয়।
খেলাপি ঋণের নীতিমালায় ছাড় তুলে নেওয়ার শর্তের ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, এটি নিজেদের প্রয়োজনেই করা উচিত। ঋণখেলাপিদের কোনো ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। এটি এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া তিনি আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। রিজার্ভের হিসাব আন্তর্জাতিক মানেই হওয়া উচিত। এটি আইএমএফ অনেক দিন ধরেই বলছে। এটি করা উচিত।
সূত্র জানায়, আইএমএফের ঋণ পেতে সরকার তাদের প্রধান শর্তগুলো আলোচনা শুরুর আগেই বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৯ থেকে ৫২ শতাংশ। সার ও গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। ভর্তুকি কমানোই হচ্ছে আইএমএফের প্রধান শর্ত। এসব ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। এদিকে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সচিবদের বৈঠক করে ভর্তুকি বাজেটে বরাদ্দ অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এর মাধ্যমেও বার্তা দেওয়া হয়েছে সরকার ভর্তুকি খুব বেশি বাড়াবে না। ফলে আইিএমএফের আরও একটি শর্তের বাস্তবায়নের আভাস পাওয়া গেল। তারপরও আইএমএফ গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়ানোর শর্ত আরোপ করেছে। তারা বলেছে, দাম বাড়ানোর পরও সরকারের অনেক সংস্থা এখনো লোকসান দিচ্ছে। লোকসানি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সরকার এগোতে পারবে না। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের এ যুক্তি সব দেশের ও সব সময়ে সঠিক নয়। এখন জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির হার লাফ দিয়ে বেড়ে যাবে। ফলে এগুলোর দাম এখন বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ এখন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণই মূল লক্ষ্য। আর বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশকে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দিতে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সার এগুলোতে ভর্তুকি দিতে হয়। ভর্তুকি না দিলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশিমাত্রায় বেড়ে যাবে। যেটি সাধারণ মানুষ সহ্য করতে পারবে না।
তবে এই ভর্তুকির যাতে কোনো অপব্যবহার না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। সূত্র জানায়, আইএমএফ বলেছে, পেট্রোবাংলা লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে আবেদন করেছে। কিন্তু বাড়ানো হচ্ছে না। একইভাবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তারা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে। কিন্তু বাড়ানো হচ্ছে না। এ কারণ জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
এ প্রসঙ্গে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। কারণ এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে। আইএমএফ এ বিষয়ে নমনীয় বলে জানা গেছে। এছাড়া তারা কৃষি খাতে ভর্তুকির ব্যাপারেও এবার নমনীয়। এ নিয়ে কিছুই বলেনি। যদিও অন্য সময় এ খাতের ভর্তুকিও তুলে দেওয়ার শর্ত দিত। সূত্র জানায়, এবার আইএমএফ অর্থনীতির তিনটি মৌলিক সূচক নিয়ে জোর আপত্তি তুলেছে। এগুলো নিয়ে তাদের আগেও আপত্তি ছিল। কিন্তু তত জোরালো নয়। এগুলো হচ্ছে, রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ, জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, খেলাপি ঋণের নীতিমালায় ছাড় বন্ধ করা।
এ প্রসঙ্গে সরকার থেকে বলা হয়েছে, জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার বিষয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো কাজ করছে। এটি এখনই করা সম্ভব নয়। সময় লাগবে। রিজার্ভ পদ্ধতির হিসাবের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তারা এখনই রিজার্ভের দুটি হিসাব করে। এর মধ্যে একটি গ্রস ও অপরটি নিট। এখন গ্রস হিসাবটি প্রকাশ করা হয়, নিট হিসাবটি প্রকাশ করা হয় না। তবে এটি সংশ্লিষ্টরা জানেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট হিসাব করতে কোনো আপত্তি নেই।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে আইএমএফ। বর্তমানে কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় শেষ হওয়ার পর থেকে ছয় মাস পরে তা খেলাপি করা হয়। আন্তর্জাতিক মানে তা তিন মাস করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনার কারণে এ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। করোনার প্রভাবের পর বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ খাতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এর প্রভাব কেটে গেলে তা তুলে নেওয়া হবে। আগে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানেই ছিল। ২০২০ সালে তা শিথিল করা হয়। ডলারের বিনিময় হার ইতোমধ্যেই বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আইএমএফের তিনটি প্রধান শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে আইএমএফের শর্তগুলো নতুন নয়। এগুলো করা উচিত ছিল অনেক আগে থেকেই। সরকার করেনি। কিন্তু এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। সার্বিকভাবে এ শর্তটি আইএমএফের প্রধান শর্তের মধ্যে নেই। তিনি আরও বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির কারণে লোকসান দেয়। আইএমএফ দুর্নীতি বন্ধ করতে না বলে পণ্যের দাম বাড়ানোর শর্ত আরোপ করে। এটা ঠিক নয়, তারা বলুক গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে কোথায় কী ধরনের দুর্নীতি আছে সেটি বের করে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
তাহলে তো আর দাম বাড়ানোর প্রশ্ন আসে না। সূত্র জানায়, আইএমএফের আরও একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে, রাজস্ব আয় বাড়ানো। বর্তমানে বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। আইএমএফ এটিকে ১৪ শতাংশে উন্নীত করতে বলেছে। এজন্য বিভিন্ন খাতে করহার বাড়াতে হবে। এদিকে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কমাতে বলেছে। এ বিষয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে। এটি রাতারাতি সম্ভব নয়।